মির্জা আব্বাসের বক্তব্যে বিএনপি–জামায়াত সম্পর্কে নতুন সংকেত: ইতিহাস, মতাদর্শ ও বর্তমান রাজনীতির জটিল সমীকরণ

বাংলাদেশের রাজনীতির গতি যেমন দ্রুত পরিবর্তনশীল, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ ও পারস্পরিক সম্পর্কও পরিবর্তিত হয় প্রয়োজনে, বিতর্কে কিংবা মতাদর্শে। এই প্রেক্ষাপটে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের সাম্প্রতিক বক্তব্য এক নতুন রাজনৈতিক বার্তা বহন করছে। সিদ্ধেশ্বরীতে একটি মেডিক্যাল ক্যাম্প উদ্বোধনে দেওয়া তাঁর বক্তব্য শুধু জামায়াতকে লক্ষ্য করে ক্ষোভ প্রকাশ নয়; বরং এটি বাংলাদেশে বিরোধী রাজনীতির নতুন বিন্যাসে ইঙ্গিত করছে।

বক্তব্যের শুরুতেই তিনি জামায়াত সম্পর্কে বলেন, “আপনাদের ওষুধ হলো আওয়ামী লীগ। কোনো ভদ্র লোকের সঙ্গে ওরা কাজ করতে পারবে না।” এই মন্তব্য রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি–জামায়াত একই জোটে থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের সম্পর্ক দূরবর্তী। আব্বাসের মন্তব্য সেই দূরত্বকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে।

তিনি আরও বলেন, জামায়াত “ধর্ম বিকৃতকারী দল”—যারা মওদুদবাদের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ইসলামকে বিকৃত করেছে। তাঁর দাবি, জনগণকে এই দলের “বিভ্রান্তিকর ধর্মীয় ব্যাখ্যা” থেকে সাবধান থাকতে হবে। রাজনৈতিকভাবে এটি শুধু জামায়াতের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত চ্যালেঞ্জ নয়, বরং বিএনপির ভবিষ্যৎ জোট রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে—তারও ইঙ্গিত।

বক্তব্যে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গও আনেন মির্জা আব্বাস। তাঁর মতে, রাজাকার–আলবদরদের দেশবিরোধী ভূমিকার কারণে জামায়াত জনগণের কাছে নৈতিক বৈধতা হারিয়েছে। তাঁর সেই মন্তব্য—*“যারা বাংলাদেশ চায়নি, তারাই এখন ভোট চাইছে”—*জামায়াতের বর্তমান রাজনৈতিক কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ ধরনের বক্তব্য সাধারণত তখনই উঠে আসে যখন একটি দল তার রাজনৈতিক অবস্থান বা জোট কাঠামো পুনর্বিন্যাস করতে চায়। বিএনপির অভ্যন্তরে অনেকে মনে করছেন, জামায়াতের অতীতের বিতর্কসহ আন্তর্জাতিক চাপ বিবেচনায় দলটি হয়তো নতুন রাজনৈতিক কৌশল তৈরি করছে—যেখানে ধর্মভিত্তিক দল থেকে দূরে সরে ‘মধ্যপন্থী ও গণতান্ত্রিক ব্লক’ গঠন সম্ভব।

এ ছাড়া আব্বাসের ভাষায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু। তিনি আওয়ামী লীগকে “অভদ্র দল” অভিহিত করে বলেন, জামায়াত ও আওয়ামী লীগ একই রকম রাজনীতি করে। এই তুলনা তৈরি করে তিনি দুই দলের মতাদর্শিক ব্যবধানকে ছোট করে বিএনপিকে নিজের অবস্থানে নৈতিক উচ্চতায় দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন।

অনুষ্ঠান শেষে তিনি খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় দোয়া চাইলে বোঝা যায়, বিএনপি এখনো তাদের রাজনৈতিক কৌশলের কেন্দ্রে খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব, প্রতীকী গুরুত্ব ও জনমানসের আবেগকে ধরে রাখতে চায়।

সার্বিক বিবেচনায়, মির্জা আব্বাসের বক্তব্য শুধু একটি রাজনৈতিক বক্তৃতা নয়—বরং এটি বাংলাদেশের বিরোধী রাজনীতির ভেতরকার জটিল সমীকরণ, মতাদর্শগত টানাপোড়েন, জোট রাজনীতির সম্ভাব্য পুনর্বিন্যাস এবং রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত বহন করছে। আসন্ন নির্বাচন, আন্দোলন এবং বিরোধী ঐক্য—সবকিছুর ওপর এর প্রভাব পড়তে পারে।