দেশে চলমান মব সন্ত্রাস বা উন্মত্ত জনতার তাণ্ডব নিয়ন্ত্রণে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে গভীর উদ্বেগ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা। বিশেষ করে ১৮ ডিসেম্বর রাতে শরীফ ওসমান হাদির মৃত্যুর পর প্রথম আলো, ডেইলি স্টার এবং ছায়ানটের মতো প্রতিষ্ঠানে যেভাবে হামলা চালানো হয়েছে, তাকে তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘স্পষ্ট শৈথিল্য’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বিশেষ অনুষ্ঠান ‘ইনসাইড আউট’-এ অংশ নিয়ে তিনি বলেন, মব নিয়ন্ত্রণে হতাহতের যে আশঙ্কার কথা পুলিশ বলছে, তা কোনো পেশাদার বাহিনীর জন্য গ্রহণযোগ্য নয় বরং এটি একটি ‘মন্দ অজুহাত’।
নুরুল হুদার মতে, ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর পুলিশের ওপর যে ট্রমা বা মানসিক ধাক্কা এসেছিল, তাকে পুঁজি করে দেড় বছর পরেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ঢিলেমি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তিনি মনে করেন, পুলিশের কাজই হলো প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করা এবং যারা শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্তিশালী, তারাই এই বাহিনীতে কাজ করবেন। ১৮ ডিসেম্বরের ঘটনাটি ছিল পরিকল্পিত এবং একে নিছক উন্মত্ত জনতা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। নির্দিষ্ট আদর্শের সাংস্কৃতিক ও সংবাদ প্রতিষ্ঠানের ওপর এই আক্রমণ ইঙ্গিত দেয় যে, কিছু গোষ্ঠী অত্যন্ত সুসংগঠিতভাবে কাজ করছে যাদের দ্রুত চিহ্নিত করা জরুরি।
সাবেক এই পুলিশ প্রধানের পর্যবেক্ষণ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বর্তমান চিত্র নিচের সারণিতে তুলে ধরা হলো:
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও মব সন্ত্রাস নিয়ে সাবেক আইজিপির বিশ্লেষণ
| আলোচনার বিষয় | নুরুল হুদার গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ |
| ১৮ ডিসেম্বর রাতের হামলা | গোয়েন্দা তথ্যের অভাব ও সময়মতো অ্যাকশন না নেওয়ার কারণে এই তাণ্ডব ঘটেছে। |
| পুলিশের ট্রমা ও অজুহাত | হতাহতের আশঙ্কায় অ্যাকশন না নেওয়া একটি দুর্বল অজুহাত; পেশাদারিত্বে এর স্থান নেই। |
| হাদি হত্যাকাণ্ড | এটি কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ কি না তা উদঘাটনে দ্রুত আসামিদের গ্রেপ্তার প্রয়োজন। |
| গানম্যান ও নিরাপত্তা | গানম্যান নিয়োগ কেবল সাময়িক সমাধান; স্থায়ী ঝুঁকির ক্ষেত্রে অস্ত্রের লাইসেন্স কাম্য। |
| শান্তিপূর্ণ নির্বাচন | ক্যাম্পেইন শুরু হলে টেনশন সারা দেশে ভাগ হয়ে যাবে, ফলে শান্তিপূর্ণ ভোট সম্ভব। |
| সাম্প্রদায়িক সহিংসতা | ময়মনসিংহের মতো পিটিয়ে হত্যার ঘটনা আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে। |
শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের সম্ভাবনা নিয়ে নুরুল হুদা আশাবাদী। তিনি মনে করেন, নির্বাচন যখন দেশব্যাপী শুরু হবে, তখন ঢাকাকেন্দ্রিক মব করার মতো লোক এক জায়গায় জড়ো থাকতে পারবে না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রয়োজনে ৫০০ থেকে ১০০০ চিহ্নিত বিশৃঙ্খলাকারীকে নির্বাচনের আগে গ্রেপ্তার করার পরামর্শ দেন তিনি। তার মতে, বর্তমানে পরিস্থিতি যতটা ভয়াবহ দেখানো হচ্ছে, আসলে মাঠপর্যায়ে কঠোর শাসন থাকলে তা সহজেই নিয়ন্ত্রণযোগ্য।
সাম্প্রদায়িক উসকানি ও ধর্মের নামে উন্মাদনা প্রসঙ্গে সাবেক এই আইজিপি অত্যন্ত কঠোর অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। তিনি মনে করেন, অতীতে রামু বা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মতো ঘটনায় সব দলের স্বার্থান্বেষী মহলের অংশগ্রহণ ছিল। এই ধরনের সাম্প্রদায়িক ঘৃণা বা জিঘাংসা দূর করতে দীর্ঘমেয়াদী শিক্ষার পাশাপাশি বর্তমান সরকারকে অত্যন্ত দৃঢ় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। গোয়েন্দা সংস্থাকে ঢেলে সাজিয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে মব সন্ত্রাস নির্মূল করা সম্ভব। পরিশেষে তিনি মনে করিয়ে দেন যে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো স্তরেই শৈথিল্য দেখানোর অবকাশ নেই।
