বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যে কজন মানুষ একাধিক পরিচয়ে দীপ্ত হয়ে আছেন, তাঁদের মধ্যে নারায়ণ ঘোষ মিতা একটি অনন্য নাম। তিনি ছিলেন একাধারে প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, অভিনেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিবেদিতপ্রাণ শব্দসৈনিক। শিল্পসৃষ্টি ও মুক্তির সংগ্রাম—এই দুইয়ের সংমিশ্রণেই গড়ে উঠেছিল তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন ও কর্মভুবন।
১৯৩২ সালের ২২ ডিসেম্বর পুরান ঢাকার এক সংস্কৃতিমনস্ক পরিবারে তাঁর জন্ম। শৈশব থেকেই সাহিত্য, নাটক ও সংগীতের আবহে বেড়ে ওঠা নারায়ণ ঘোষ মিতার মননে গড়ে ওঠে শিল্পচেতনা ও মানবিক মূল্যবোধ। সেই চেতনারই প্রতিফলন দেখা যায় তাঁর পরবর্তী জীবনের সৃষ্টিকর্মে। ষাটের দশকে তিনি চলচ্চিত্রাঙ্গনে পা রাখেন এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নিজস্ব ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলাদা করে নজর কাড়েন।
১৯৬৮ সালে নির্মিত ‘এতটুকু আশা’ চলচ্চিত্রে পারিবারিক টানাপোড়েন, সম্পর্কের সূক্ষ্মতা ও মানবিক অনুভূতির গভীরতা অত্যন্ত সংবেদনশীলভাবে তুলে ধরে তিনি দর্শক ও সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করেন। এর আগেই গোলাম মুস্তাফা ও সুচন্দাকে নিয়ে নির্মিত ‘চাওয়া পাওয়া’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্রে শিশু শিল্পী হিসেবে অভিষেক ঘটে পরবর্তীকালের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ও খ্যাতিমান নৃত্যশিল্পী শুভ্রার। ১৯৬৯ সালে নির্মিত ‘নীল আকাশের নীচে’ চলচ্চিত্রে পারিবারিক বন্ধন, দায়িত্ববোধ ও সামাজিক মূল্যবোধকে মমতা ও আবেগের সঙ্গে উপস্থাপন করেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতা ও মানুষের অন্তর্গত হতাশার প্রতিচ্ছবি উঠে আসে তাঁর ১৯৭৪ সালের চলচ্চিত্র ‘আলোর মিছিল’-এ। যুদ্ধোত্তর বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম ও মূল্যবোধের সংকট তিনি সাহসিকতার সঙ্গে পর্দায় তুলে ধরেন, যা সে সময়ের জন্য ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে—নীল আকাশের নীচে, সাহেব, এতটুকু আশা, অলঙ্কার, সুখের সংসার, কখগঘঙ এবং দীপ নেভে নাই।
অভিনেতা হিসেবেও নারায়ণ ঘোষ মিতা ছিলেন স্মরণীয়। বিশেষ করে ‘কাঁচের স্বর্গ’ চলচ্চিত্রে তাঁর সংবেদনশীল অভিনয় আজও দর্শকের মনে গভীর ছাপ রেখে গেছে। ১৯৭৫ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের প্রথম আসরেই ‘লাঠিয়াল’ চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ প্রযোজক—এই দুই বিভাগে পুরস্কার লাভ করেন, যা তাঁর সৃজনশীলতার অনন্য স্বীকৃতি।
পরবর্তী সময়ে তিনি ওপার বাংলায় পাড়ি জমালেও সেখানেও নির্মাণ করেন একাধিক রুচিশীল চলচ্চিত্র ও নাটক। ‘জল্লাদের দরবার’ নাটকে রাজু আহমেদ, আজমল হুদা মিঠু ও কল্যাণ মিত্রের সঙ্গে অভিনয় করে তিনি দর্শক ও সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করেন।
তবে তাঁর জীবনের সবচেয়ে গৌরবময় পরিচয় তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক। অস্ত্রের পাশাপাশি কণ্ঠ ও সৃষ্টিশীলতাকে তিনি ব্যবহার করেছিলেন মুক্তির সংগ্রামে। অজানা অভিমান ও গভীর কষ্ট বুকে নিয়ে একসময় দেশ ছেড়েছিলেন এই শিল্পী। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন তিন পুত্র ও এক কন্যার জনক।
২০০২ সালের ১ ডিসেম্বর এই প্রথিতযশা চিত্র পরিচালক পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমান। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারায়ণ ঘোষ মিতা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
