ইসলামি ব্যাংকিং খাতের জোরালো উত্থান, রেমিট্যান্সে রেকর্ড—তবে রপ্তানি কমে গেছে

বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং খাত ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এক অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যা দেশের সামগ্রিক আর্থিক খাতের জন্য নতুন দিক নির্দেশনা তৈরি করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, ইসলামী ব্যাংকগুলো আমানত, বিনিয়োগ, সম্পদ ও রেমিট্যান্স—সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চারটি খাতে দৃঢ় উত্থান দেখিয়েছে। যদিও রপ্তানি আয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে, তবুও অন্যান্য খাতে প্রবৃদ্ধি এ পতনের প্রভাবকে অনেকটাই ভারসাম্যপূর্ণ করেছে।

প্রতিবেদন অনুসারে, ইসলামী ব্যাংকগুলোর আমানত ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের টাকা ৪.৩৪ ট্রিলিয়ন থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বেড়ে ৪.৬৭ ট্রিলিয়নে দাঁড়িয়েছে, যা ৭.৫২ শতাংশ বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়। এই প্রবৃদ্ধি প্রমাণ করে যে গ্রাহকরা ক্রমেই শরিয়াহ-মেনে চলা ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর আরও বেশি আস্থা রাখছেন। অন্যদিকে, মোট ব্যাংকিং ব্যবস্থার আমানত ১৮.৫৮ ট্রিলিয়ন থেকে বেড়ে ২০.৬৩ ট্রিলিয়নে গিয়ে দাঁড়িয়েছে—১১.০২ শতাংশ বৃদ্ধির সঙ্গে।

ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ খাতেও শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। ৫.১৭ ট্রিলিয়ন থেকে বেড়ে ৫.৭৩ ট্রিলিয়ন টাকায় পৌঁছানো মানে ১০.৮৬ শতাংশ বৃদ্ধি, যা পুরো ব্যাংকিং খাতের গড় প্রবৃদ্ধির সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক। একই সময়ে ব্যাংকিং খাতের মোট বিনিয়োগ ২০.৮৪ ট্রিলিয়ন থেকে ২৩.২৮ ট্রিলিয়নে উঠে ১১.৭২ শতাংশ উন্নতি ঘটেছে।

এই প্রবৃদ্ধি ব্যাংকগুলোর মোট সম্পদেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ইসলামী ব্যাংকগুলোর সম্পদ ২০২৪ সালে ৮.৫০ ট্রিলিয়ন টাকা থাকলেও ২০২৫ সালে তা বেড়ে ৯.৫৪ ট্রিলিয়নে পৌঁছেছে—১২.২৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্রাহকের বাড়তি আস্থা, নীতি-নির্ভর ব্যাংকিং এবং শরিয়াহভিত্তিক সেবা বৃদ্ধির কারণেই এই অগ্রগতি।

তবে রপ্তানি আয়ের খাতে প্রভাবটি নেতিবাচক। $৮৩৭ মিলিয়ন থেকে কমে $৭০৩ মিলিয়নে নেমে আসা মানে ১৬ শতাংশ পতন—যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। একদিকে বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ছে, অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরীণ শিপমেন্ট বিলম্ব ও উৎপাদন ব্যাঘাত রপ্তানি আয়কে চাপে ফেলছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইসলামী ব্যাংকগুলোকে রপ্তানিমুখী গ্রাহকদের জন্য আরও উপযোগী পণ্য তৈরি করতে হবে এবং ট্রেড ফাইন্যান্সে দক্ষতা বাড়াতে হবে।

অপরদিকে, আমদানি পরিশোধেও ৫.২৩ শতাংশ হ্রাস হয়েছে—$১.০৭ বিলিয়ন থেকে $১.০১ বিলিয়নে নেমে এসেছে। অর্থনীতির ওপর এর প্রভাব দ্বিমুখী—একদিকে শিল্প খাতে আমদানি কমছে, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার চাপ কিছুটা কমছে।

ইসলামী ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে বড় সাফল্য এসেছে রেমিট্যান্সে। রেমিট্যান্সে তাদের শেয়ার ২২.৪৫ শতাংশ থেকে ৩০.৪৪ শতাংশে উঠে গেছে, যা প্রমাণ করে প্রবাসীদের কাছে ইসলামী ব্যাংকের প্রতি আস্থা অনেক বেশি বেড়েছে। রেমিট্যান্সের মোট পরিমাণও $৫৪০ মিলিয়ন থেকে বেড়ে $৮১৮ মিলিয়নে পৌঁছেছে। দ্রুত সেবা, কম চার্জ এবং গ্রাহককেন্দ্রিক নীতি এ উত্থানের মূল কারণ।

এছাড়া এজেন্ট ব্যাংকিং খাতেও ইসলামী ব্যাংকগুলো তাদের শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে। ২০২৪ সালের ২০৯ বিলিয়ন টাকার আমানত ২০২৫ সালে বেড়ে ২৬৪ বিলিয়নে পৌঁছেছে—২৬.৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ব্যাংকিং সেবা গ্রহণে ইসলামী ব্যাংকের ভূমিকা ক্রমেই বাড়ছে।

নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, এই প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোয় ইসলামী ব্যাংকিংয়ের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করেছে। পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. মসরুর রেয়াজ বলেন, “এসব সংখ্যা দেখায় যে ইসলামী ব্যাংকিং ভবিষ্যতের অর্থনীতিতে প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠছে।”

তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, রপ্তানি আয় হ্রাস একটি গুরুতর বার্তা দেয়, এবং দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে ব্যাংকগুলোকে শাসনব্যবস্থা, দক্ষতা ও উদ্ভাবনে আরও মনোযোগী হতে হবে।

ডাটা টেবিল ( বাংলাদেশ ব্যাংকের  তথ্য অনুযায়ী)

সূচকসেপ্টেম্বর ২০২4সেপ্টেম্বর ২০২5প্রবৃদ্ধি
ইসলামিক ব্যাংকের জমাTk ৪.৩৪ ট্রিলিয়নTk ৪.৬৭ ট্রিলিয়ন৭.৫২%
ইসলামিক ব্যাংকের বিনিয়োগTk ৫.১৭ট্রিলিয়নTk ৫.৭৩ ট্রিলিয়ন১০.৮৬%
মোট ব্যাংকিং জমাTk ১৮.৫৮ ট্রিলিয়নTk ২০.৬৩ ট্রিলিয়ন১১.০২%
মোট ব্যাংকিং বিনিয়োগTk ২০.৮৪ ট্রিলিয়নTk ২৩.২৮ ট্রিলিয়ন১১.৭২%
ইসলামিক ব্যাংকের মোট সম্পদTk ৮.৫০ ট্রিলিয়নTk ৯.৫৪ ট্রিলিয়ন১২.২৬%
রপ্তানি আয়$৮৩৭ মিলিয়ন$৭০৩ মিলিয়ন-১৬%
আমদানি ব্যয়$১.০৭ বিলিয়ন$১.০১ বিলিয়ন-৫.২৩%
রেমিট্যান্স$৫৪০ মিলিয়ন$৮১৮ মিলিয়ন৫১.৪৮%
এজেন্ট ব্যাংকিং জমাTk ২০৯ বিলিয়নTk ২৬৪ বিলিয়ন২৬.৩৫%