শিক্ষিত জনগোষ্ঠী যেভাবে মিথ্যা প্রোপাগান্ডার ফাঁদ এড়াবেন

আমাদের সমাজে একটি প্রচলিত ধারণা আছে—মিথ্যা প্রোপাগান্ডার ফাঁদে মূলত অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীই পড়ে। কিন্তু আধুনিক বিশ্বব্যাপী গবেষণা ও মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ বলছে, এই ধারণা পুরোপুরি সঠিক নয়। বাস্তবতা হলো, শিক্ষিত মানুষেরাও ব্যাপকভাবে মিথ্যা প্রোপাগান্ডার শিকার হন—এবং অনেক ক্ষেত্রে তারা আরও সূক্ষ্ম, জটিল ও গভীর প্রোপাগান্ডায় আক্রান্ত হন।

মনোবিজ্ঞানীরা একে অস্বাভাবিক কিছু মনে করেন না। বরং তারা বলেন, এটি মানুষের চিন্তা-প্রক্রিয়া, আবেগ ও সামাজিক আচরণের স্বাভাবিক দুর্বলতার ফল। নিচে সেই কারণগুলো একটু গভীরভাবে দেখা যাক—

ফাঁদ পড়ে যেভাবে:

. শিক্ষা মানেই সমালোচনামূলক চিন্তা নয়

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা বহুক্ষেত্রে তথ্য মুখস্থ করতে শেখায়, কিন্তু তথ্য যাচাই, প্রশ্ন তোলা বা যুক্তিভিত্তিক বিশ্লেষণের অভ্যাস গড়ে তোলে না। ফলে ডিগ্রি, পদবি বা একাডেমিক সাফল্য থাকা সত্ত্বেও মানুষ ভুয়া তথ্যকে প্রশ্নহীনভাবে গ্রহণ করতে পারে।

. নিশ্চিত বিশ্বাস আদর্শগত পক্ষপাত

মানুষ সাধারণত সেই তথ্যই গ্রহণ করতে চায়, যা তার আগের বিশ্বাস, রাজনৈতিক অবস্থান বা আদর্শকে শক্তিশালী করে। এটিকে মনোবিজ্ঞানে বলা হয় confirmation bias। প্রোপাগান্ডা নির্মাতারা এই দুর্বলতাকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করে।

. আবেগ জাগলে যুক্তি দুর্বল হয়

ধর্ম, দেশপ্রেম, জাতিগত পরিচয়, ভয়, অপমানবোধ বা ঘৃণার মতো আবেগ যুক্ত হলে শিক্ষিত মানুষের যুক্তিবোধও পেছনে পড়ে যায়। প্রোপাগান্ডা খুব সচেতনভাবে যুক্তির চেয়ে আবেগকে আঘাত করে—কারণ আবেগ মানুষকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে।

. বিশ্বাসযোগ্যতার ছদ্মবেশ

ভুয়া তথ্য প্রায়ই “বিশেষজ্ঞ”, “ডক্টর”, “বিদেশি গবেষণা”, “আন্তর্জাতিক মিডিয়া” কিংবা পরিচিত মুখের উদ্ধৃতি ব্যবহার করে। শিক্ষিত মানুষ উৎস দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে যায়, কিন্তু উৎসটির সত্যতা বা প্রেক্ষাপট যাচাই করে না।

. তথ্যঅতিরিক্ততার ক্লান্তি

আজকের যুগে আমরা প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ তথ্যের মুখোমুখি হই। সব তথ্য যাচাই করার মতো মানসিক শক্তি বা সময় অনেকেরই থাকে না। ফলে মানুষ সহজ ব্যাখ্যা, চটকদার গল্প বা সংক্ষিপ্ত উপসংহারকে সত্য ধরে নেয়।

. গ্রুপ আইডেন্টিটি সামাজিক চাপ

বন্ধু, সহকর্মী, পছন্দের রাজনৈতিক বা আদর্শিক গ্রুপ যদি কোনো বক্তব্যে বিশ্বাস করে, তাহলে শিক্ষিত মানুষও অনেক সময় ভিন্নমত প্রকাশ করতে ভয় পায়। “গ্রুপের বাইরে পড়ে যাওয়া”র আশঙ্কা যুক্তির জায়গা দখল করে নেয়।

. অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের ফাঁদ

“আমি তো শিক্ষিত, আমি ধোঁকায় পড়ব না”—এই ধারণাটাই অনেক সময় সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। এই overconfidence মানুষকে নিজের চিন্তাকে প্রশ্নহীনভাবে বিশ্বাস করতে শেখায়।

. আধুনিক প্রোপাগান্ডা এখন বিজ্ঞানভিত্তিক

আজকের প্রোপাগান্ডা আর কেবল স্লোগান বা পোস্টার নয়। এটি মনোবিজ্ঞান, ডেটা অ্যানালিটিক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও অ্যালগরিদম ব্যবহার করে মানুষের ভয়, আগ্রহ ও দুর্বলতাকে লক্ষ্য করে তৈরি হয়। তাই সাধারণ শিক্ষা দিয়ে এর বিরুদ্ধে টিকে থাকা কঠিন।

 

তাহলে বাঁচার উপায় কী?

প্রোপাগান্ডা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো সহজ সূত্র নেই, তবে কিছু অভ্যাস মানুষকে অনেকটা সুরক্ষিত রাখতে পারে—

  • নিজের বিশ্বাসের বিপরীত মতামত পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা
  • আবেগ জাগানো কোনো খবর দেখলে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া বা শেয়ার না করা
  • একাধিক স্বাধীন ও নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে তথ্য যাচাই করা
  • নিজেকে প্রশ্ন করা—এই তথ্য আমাকে কেন বিশ্বাস করাতে চাচ্ছে?”
  • উৎস, সময়, প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য—এই চারটি বিষয় খেয়াল করা

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো—
প্রোপাগান্ডায় পড়া বুদ্ধির অভাব নয়; এটি মানবিক দুর্বলতার ফল।

এই দুর্বলতাকে স্বীকার করা, নিজের চিন্তাকে নিয়মিত প্রশ্ন করা এবং সচেতন আত্মসমালোচনাই হলো প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা।

 

এবিএম জাকিরুল হক টিটন

সম্পাদক