যেমন ছিল ২০২৫ সাল বাংলাদেশের সংগীত জগত

২০২৫ সাল বাংলাদেশের সংগীত জগতের জন্য ছিল বৈপরীত্যে ভরা এক বছর। একদিকে সিনেমা, নাটক ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত বেশ কিছু গান শ্রোতাদের মনে গভীর ছাপ ফেলেছে, অন্যদিকে অডিও গানের বাজার ছিল প্রায় স্থবির। টানা কয়েক বছর ধরেই শীর্ষ প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো অডিও গান প্রকাশে অনাগ্রহী, ফলে এই খরা আরও প্রকট হয়েছে। এর বিপরীতে সিনেমার গানই আবারও সংগীত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে।

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও কোক স্টুডিও বাংলার দাপট ছিল এ বছর চোখে পড়ার মতো। সবচেয়ে আলোচিত গানের তালিকায় নিঃসন্দেহে শীর্ষে থাকবে কোক স্টুডিও বাংলায় প্রকাশিত রুনা লায়লার ‘দমা দম মাস্ত কালান্দার’। কিংবদন্তি এই শিল্পীর কণ্ঠে নতুন সংগীতায়োজনে গানটি মুক্তির আগেই শ্রোতাদের কৌতূহল জাগিয়েছিল। মুক্তির পর সেই প্রত্যাশা পূরণ করে গানটি প্রমাণ করে দেয়—ভালো সংগীত প্রজন্মের সীমা পেরিয়ে শ্রোতাদের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করতে পারে।

এরপরই আলোচনায় আসে হাবিব ওয়াহিদের ‘মহাজাদু’। তাজিকিস্তানের শিল্পী মেহেরনিগর রুস্তমের সঙ্গে গাওয়া এই ফিউশন লোকগানটি বছরের অন্যতম সেরা সংগীত প্রয়াস হিসেবে বিবেচিত হয়। লোকগানের আধুনিক উপস্থাপন এখনো যে শ্রোতাদের আকর্ষণ করে, হাবিব সেটিই আবারও প্রমাণ করেছেন। কোক স্টুডিও থেকেই মুক্তি পাওয়া ‘লং ডিসট্যান্স লাভ’ গানটিও বছরজুড়ে শ্রোতাপ্রিয়তার তালিকায় ছিল। অঙ্কন কুমার ও শেখ মুমতাহিনা মেহজাবিন আফরিনের কণ্ঠে গানটি রোমান্টিক ধারার নতুন মাত্রা যোগ করে।

ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ২০২৫ সালে বেশ কয়েকটি গান ব্যাপক সাড়া ফেলে। ঈশান মজুমদারের ‘গুলবাহার’ তিন কোটির বেশি ভিউ ছাড়িয়ে যায়। সাইফ জোহানের ‘কিছু মানুষ মরে যায় পঁচিশে’ গানটি কথার গভীরতা ও সংবেদনশীল সুরে প্রায় দুই কোটি দর্শকের মন ছুঁয়ে যায়। পারভেজ খানের ‘আমার বন্ধুরও বন্ধু আছে’ এবং মরিয়ম ইসলামের ‘রাগের মাথায় কইলে কিছু রাইখো না অন্তরে’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রেন্ড তৈরি করে। বিশেষভাবে আলোচিত ছিল সানজিদা রিমির ‘তুই আমার আলতা চুড়ি না’, যা বছরের শুরুতেই প্রকাশ পেয়ে পাঁচ কোটির বেশি ভিউ অর্জন করে।

২০২৫ সালে সিনেমার গানই ছিল সংগীত জগতের সবচেয়ে শক্তিশালী ভিত্তি। ‘বরবাদ’ সিনেমার ‘চাঁদমামা’ ও ‘মহামায়া’, ‘তাণ্ডব’-এর ‘লিচুরও বাগানে’, ‘জিন-৩’-এর ‘কন্যা’ এবং ‘জংলি’ সিনেমার ‘বন্ধু গো শোনো’ প্রমাণ করে, সিনেমার গান এখনো মূলধারার শ্রোতাদের প্রধান বিনোদন।

নাটকের গানেও ছিল সাফল্য। হাবিব ওয়াহিদ ও ন্যান্সির কণ্ঠে ‘আমার দিনগুলো সব হারিয়ে যায় আঁধারে’ গানটি ২ কোটি ৪০ লাখ ভিউ ছাড়ায়। কনা ও সজীব দাসের ‘যদি মনটা করি চুরি’ এবং ‘এত প্রেম এত মায়া’ গানগুলোও নাটকের গানের জনপ্রিয়তা ধরে রাখে।

তবে গানের এই সাফল্যের বিপরীতে ২০২৫ সাল কনসার্ট শিল্পের জন্য ছিল হতাশাজনক। নিরাপত্তাজনিত কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক কনসার্ট বাতিল ও স্থগিত হয়। ঢাকায় আতিফ আসলামের কনসার্ট, জেমস ও আলী আজমতের যৌথ কনসার্টসহ ডিসেম্বরেই অন্তত ১০টি কনসার্ট বাতিল ঘোষণা করা হয়। এতে শিল্পী, মিউজিশিয়ান ও আয়োজকরা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন।

সব মিলিয়ে ২০২৫ সাল প্রমাণ করেছে—ভালো গান এখনো শ্রোতা খুঁজে নেয়, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম নতুন শিল্পীদের সামনে আনে, কিন্তু লাইভ মিউজিক ও অডিও ইন্ডাস্ট্রি এখনো বড় সংকটে। তাই এই বছর বাংলাদেশের সংগীত ইতিহাসে স্মরণীয় থাকবে সাফল্য ও হতাশার দ্বন্দ্বময় এক অধ্যায় হিসেবে।