দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত অন্যতম প্রাচীন ও পরিচিত বেসরকারি ব্যাংক পুবালী ব্যাংক লিমিটেড বর্তমানে বহুমাত্রিক সুশাসন সংকটে জর্জরিত। দীর্ঘদিন ধরে পরিচালনা পর্ষদের ভেতরে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, আদালতের রায় ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনা উপেক্ষা করে একই পর্ষদ কাঠামো বহাল রাখা এবং বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন ও ঋণ বিতরণে ধারাবাহিক অনিয়ম ব্যাংকটির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাকে গুরুতরভাবে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। নথিনির্ভর বিভিন্ন তদন্তে গুরুতর অসদাচরণ ও বিধি লঙ্ঘনের প্রমাণ মিললেও কার্যকর শাস্তিমূলক ব্যবস্থার অভাবে পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল ও উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস ডিপার্টমেন্ট (এফআইসিএসডি)-এর একটি আংশিক তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে পুবালী ব্যাংকের কয়েকটি শাখায় সংঘটিত ভয়াবহ অনিয়মের বিস্তারিত চিত্র। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকটির একাধিক শাখা আমদানি ঋণপত্র (এলসি) নিষ্পত্তির সময় নির্ধারিত বাজার দরের তুলনায় প্রতি মার্কিন ডলারে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অতিরিক্ত অর্থ আদায় করেছে। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী এই অতিরিক্ত অর্থ ব্যাংকের নিজস্ব আয় হিসেবে কোষাগারে জমা হওয়ার কথা থাকলেও, ব্যাংকিং আইন ও বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা লঙ্ঘন করে তা সরাসরি নির্দিষ্ট কিছু গ্রাহকের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে।
তদন্তে উঠে আসা একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনায় দেখা যায়, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে পুবালী ব্যাংকের বরিশাল বাজার রোড শাখা থেকে ‘মোহাম্মাদী ইলেকট্রিক ওয়্যার অ্যান্ড মাল্টি প্রোডাক্টস লিমিটেড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান ২ লাখ ২৩ হাজার মার্কিন ডলারের একটি আমদানি এলসি খোলে। এলসি দায় পরিশোধের সময় ব্যাংকটি প্রচলিত বাজার দরের তুলনায় প্রতি ডলারে প্রায় ৬.৫ টাকা বেশি আদায় করে। এর ফলে মোট প্রায় ১৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা অতিরিক্ত অর্থ সংগ্রহ করা হয়। বিস্ময়করভাবে এই অর্থ ব্যাংকের আয় হিসেবে সংরক্ষণ না করে ওই দিনই মতিঝিল করপোরেট শাখার একটি চলতি হিসাবে স্থানান্তর করা হয়, যার মালিক ‘রিফাত গার্মেন্টস লিমিটেড’।
এই লেনদেন ঘিরে সবচেয়ে বিতর্কিত দিকটি হলো, রিফাত গার্মেন্টস হা-মীম গ্রুপের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এবং হা-মীম গ্রুপের প্রতিনিধি আবদুর রাজ্জাক মন্ডল পুবালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের একজন প্রভাবশালী পরিচালক। ফলে এই ঘটনায় স্বার্থের সংঘাত, পর্ষদীয় প্রভাব খাটানো এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে।
একই ধরনের অনিয়মের চিত্র পাওয়া গেছে পুবালী ব্যাংকের সিলেট শাখাতেও। সেখানে ‘মেসার্স হাসান অ্যান্ড ব্রাদার্স’-এর চারটি আমদানি এলসির বিপরীতে আদায় করা অতিরিক্ত প্রায় ৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা একই পদ্ধতিতে রিফাত গার্মেন্টসের হিসাবে জমা করা হয়েছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে।
এফআইসিএসডির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিভিন্ন ঘটনায় প্রতি ডলারে ৬.৫ থেকে ৮ টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। দীর্ঘ সময় ধরে চলমান এই অনিয়ম প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, পর্ষদ পর্যায়ে কার্যকর তদারকির অভাব এবং শীর্ষ ব্যবস্থাপনার সম্ভাব্য যোগসাজশ ছাড়া সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা।
