আজ মাঠে গড়াচ্ছে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) ক্রিকেটের দ্বাদশ আসর। প্রতিবারের মতো এবারও টুর্নামেন্ট শুরুর আগমুহূর্তে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে বিতর্ক, অনিশ্চয়তা ও ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা। বিপিএলের ইতিহাসে বিতর্কহীন আয়োজন যেন ক্রমেই দুরাশায় পরিণত হচ্ছে। বিসিবি আগেভাগে কঠোর অবস্থান নিয়ে একটি পরিচ্ছন্ন, পেশাদার ও বিশ্বাসযোগ্য টুর্নামেন্ট আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিলেও প্রথম বল মাঠে গড়ানোর আগেই সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
গত কয়েক দিন ধরে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহে দেশের জনজীবন স্থবির। কনকনে শীতে কাঁপছে মানুষ। কিন্তু সেই ঠান্ডার মধ্যেও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম ও আশপাশের এলাকা। বিপিএলের আগের ১১ আসরে এমন চিত্র খুব একটা দেখা যায়নি। এবারের অস্বস্তিকর পরিস্থিতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল চট্টগ্রাম ফ্র্যাঞ্চাইজি, যাকে ঘিরে একের পর এক নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে।
বিসিবি এবারের বিপিএলের আগে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিল, ১০ কোটি টাকা ব্যাংক গ্যারান্টি ছাড়া কাউকে ফ্র্যাঞ্চাইজি দেওয়া হবে না। পাশাপাশি যারা দল নেবে, তাদের অন্তত পাঁচটি আসর টিকে থাকার আর্থিক সক্ষমতা থাকতে হবে। ফ্র্যাঞ্চাইজি বাছাইয়ের সময় বিসিবির পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততার কথাও জানানো হয়। উদ্দেশ্য ছিল—অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, স্বল্পমেয়াদি ও ঝুঁকিপূর্ণ মালিকানা কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসা। তবে বাস্তবতায় দেখা গেল, সেই কঠোর নীতিই শেষ পর্যন্ত বিপাকে ফেলেছে একাধিক ফ্র্যাঞ্চাইজিকে, বিশেষ করে চট্টগ্রাম রয়্যালসকে।
চট্টগ্রাম রয়্যালসকে ঘিরে গত কয়েক দিন ধরেই গুঞ্জন চলছিল। নিলামে জাতীয় দলের ওপেনার নাঈম শেখকে ১ কোটি ১০ লাখ টাকায় দলে নেওয়ার পরই প্রশ্ন উঠতে থাকে—এই অর্থ আদৌ সময়মতো পরিশোধ করা সম্ভব হবে কি না। একই অনিশ্চয়তার কারণে দলটির কোনো বিদেশি ক্রিকেটারও নির্ধারিত সময়ে বাংলাদেশে আসেননি। স্পন্সর সংকট, অর্থনৈতিক চাপ এবং অনাস্থার পরিবেশে শেষ পর্যন্ত ফ্র্যাঞ্চাইজিটির মালিক ট্রায়াঙ্গেল সার্ভিসেস লিমিটেড সরাসরি অপারগতা প্রকাশ করে।
গতকাল সকালে বিসিবিকে পাঠানো এক চিঠিতে প্রতিষ্ঠানটির মালিক কাইয়ুম রশিদ জানান, আর্থিক সংকটের কারণে তারা আর চট্টগ্রাম ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকানা ধরে রাখতে পারছেন না। খবরটি প্রকাশ্যে আসতেই দেশের ক্রিকেট অঙ্গনে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ক্রীড়া বিশ্লেষকদের আলোচনায় উঠে আসে—এত যাচাই-বাছাইয়ের পরও কীভাবে এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো? শেষ পর্যন্ত টুর্নামেন্টের ধারাবাহিকতা রক্ষা ও সূচি বিপর্যয় এড়াতে চট্টগ্রাম দলের মালিকানা নিজেদের হাতে নিতে বাধ্য হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড।
মালিকানা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রাম দলের ব্যবস্থাপনায় আসে বড় ধরনের রদবদল। নতুন করে হেড কোচের দায়িত্ব দেওয়া হয় মিজানুর রহমান বাবুকে। টিম ডিরেক্টর হিসেবে যুক্ত হন সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমন এবং টিম ম্যানেজারের দায়িত্ব পান নাফিস ইকবাল। বিশেষ ব্যবস্থায় মিজানুর রহমানকে ঢাকা থেকে সিলেটে উড়িয়ে নেওয়া হয়, যা পরিস্থিতির জরুরি গুরুত্বই তুলে ধরে।
চট্টগ্রামের মালিকানা বিসিবির হাতে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বিসিবি গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্যসচিব ইফতেখার রহমান মিঠু। তিনি স্বীকার করেন, টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই একের পর এক সমস্যায় পড়ে বোর্ড প্রচণ্ড চাপে রয়েছে। মিঠুর ভাষ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম ফ্র্যাঞ্চাইজি কোনো স্পন্সর জোগাড় করতে পারেনি। দলটির ইন্টিগ্রিটি নিয়ে নানা গুজব, সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতিবাচক আলোচনা হওয়ায় স্পন্সররা পিছিয়ে গেছে। ফলে আর্থিক বোঝা বহন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
এক সময় বিপিএল নিয়ে বিসিবির যে আত্মবিশ্বাসী বক্তব্য শোনা যাচ্ছিল, গতকাল মিঠুর কণ্ঠে ছিল ভিন্ন সুর। তিনি অকপটে বলেন, এত অল্প সময়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ও ত্রুটিমুক্ত টুর্নামেন্ট আয়োজন করা বাস্তবেই কঠিন। সবকিছু নতুন করে সাজাতে গিয়ে চাপ বেড়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তবে প্রশাসনিক অস্থিরতার মধ্যেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন চট্টগ্রামের খেলোয়াড়রা। নাঈম শেখ, শরিফুল ইসলাম ও শেখ মাহাদীর মতো ক্রিকেটারদের মুখে ফুটেছে হাসি। বিসিবি সরাসরি দায়িত্ব নেওয়ায় তারা নিজেদের পারিশ্রমিক নিয়ে এখন অনেকটাই নিশ্চিন্ত। খেলোয়াড়দের বিশ্বাস, বোর্ড থাকায় আর্থিক অনিশ্চয়তা আর থাকবে না।
অন্যদিকে বড় ধাক্কা খেয়েছে চট্টগ্রাম দলের কোচিং প্যানেল। কয়েক দিন আগেই দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক ক্রিকেটার জাস্টিন মাইলস ক্যাম্পকে হেড কোচ এবং তুষার ইমরানকে মেন্টর ও ব্যাটিং কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিসিবি মালিকানা নেওয়ার পর নতুন কোচিং কাঠামো গড়ে তোলায় এই দুই কোচের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হয়। ফলে বিপিএল শুরুর আগেই শেষ হয়ে যায় তাদের অধ্যায়।
চট্টগ্রাম ফ্র্যাঞ্চাইজির বর্তমান চিত্র সংক্ষেপে—
বিষয় | তথ্য
ফ্র্যাঞ্চাইজির নাম | চট্টগ্রাম রয়্যালস
আগের মালিক | ট্রায়াঙ্গেল সার্ভিসেস লিমিটেড
বর্তমান মালিক | বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড
নিলামে সর্বোচ্চ মূল্য | নাঈম শেখ (১ কোটি ১০ লাখ টাকা)
নতুন হেড কোচ | মিজানুর রহমান বাবু
টিম ডিরেক্টর | হাবিবুল বাশার সুমন
মালিকানা বদলের কারণ | আর্থিক সংকট ও স্পন্সর ঘাটতি
সব মিলিয়ে বিপিএলের দ্বাদশ আসর শুরুর আগেই চট্টগ্রাম ইস্যু আবারও প্রশ্ন তুলেছে দেশের ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের কাঠামো, পরিকল্পনা ও বাস্তব প্রস্তুতি নিয়ে। খেলোয়াড়দের মুখে স্বস্তির হাসি থাকলেও প্রশাসনিক স্তরের এই অস্থিরতা বিপিএলের ভাবমূর্তিকে যে নতুন করে চাপে ফেলেছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
