বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেশের গতিপথ এবং সাংবিধানিক সংস্কার নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শনিবার (১ নভেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবে মুক্তিযোদ্ধা দল আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি দেশের চলমান অস্থিরতা, নির্বাচনের রূপরেখা এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভূমিকা নিয়ে কড়া সমালোচনা করেন। তার বক্তব্যে উঠে এসেছে দেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের রোডম্যাপ এবং জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা।
Table of Contents
সাংবিধানিক সংকট ও গণভোট প্রসঙ্গ
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার বক্তব্যে স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে, বর্তমান সংবিধানে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজনের কোনো সুযোগ নেই। তিনি মনে করেন, এ ধরনের কোনো উদ্যোগ বর্তমান রাজনৈতিক জটিলতাকে আরও ঘনীভূত করবে। তিনি অভিযোগ করেন যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিজেই দেশে একটি রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি করেছে। সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, জনগণকে বিভ্রান্ত করতে পারে এমন কোনো মিথ্যা তথ্য বা অসাংবিধানিক প্রস্তাব যেন প্রচার না করা হয়।
নির্বাচনের সময়কাল ও রাজনৈতিক সংস্কার
বিএনপি মহাসচিবের মতে, ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের পর যদি তিন মাসের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হতো, তবে কোনো অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ পেত না। তিনি পিআর (প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন) বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচন নিয়ে চলমান বিতর্কের সমালোচনা করেন। তার মতে, পিআর পদ্ধতি চালু হবে কি না, তা নির্ধারণ করার দায়িত্ব জনগণের দ্বারা নির্বাচিত পরবর্তী সংসদের। নির্বাচনের আগে এই বিষয়টিকে সামনে আনা জনগণের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা বলে তিনি অভিহিত করেন।
বিএনপি দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্রের সংস্কারের কথা বলে আসছে। এই লক্ষ্যেই তারা তাদের ‘৩১ দফা’ রূপরেখা উপস্থাপন করেছে। নিচে বিএনপির প্রস্তাবিত সংস্কার ও বর্তমান রাজনৈতিক প্রত্যাশার একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হলো:
| বিষয় | বিএনপির ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব | বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন প্রেক্ষাপট |
| রাষ্ট্র কাঠামো | ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ। | সংবিধান সংস্কার কমিশনের মাধ্যমে পর্যালোচনধীন। |
| বিচার বিভাগ | বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা ও নিম্ন আদালত নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা। | বিচার বিভাগে রদবদল ও সংস্কার প্রক্রিয়া চলমান। |
| নির্বাচন পদ্ধতি | প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতি (পরবর্তী সংসদের সিদ্ধান্ত সাপেক্ষ)। | আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (PR) নিয়ে বিতর্ক চলমান। |
| দুর্নীতি দমন | ন্যায়পাল নিয়োগ এবং স্বচ্ছ দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন। | প্রশাসনিক সংস্কার ও শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা। |
| মুক্তিযুদ্ধের চেতনা | প্রকৃত ইতিহাস সংরক্ষণ ও বিকৃতি রোধ। | ইতিহাস পুনর্লিখন ও বিতর্কের নিরসন। |
ইতিহাসের বিকৃতি ও ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মির্জা ফখরুল অভিযোগ করেন যে, একটি বিশেষ গোষ্ঠী সুপরিকল্পিতভাবে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি বলেন:
“একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধই আমাদের এই রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি। যারা অতীতে এই গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামকে কেবল একটি ‘গোলমাল’ হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছিল, জাতি তাদের ক্ষমা করেনি এবং ভুলবেও না। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি আজও সক্রিয়, কিন্তু বাংলাদেশের সচেতন নাগরিকরা কোনো ষড়যন্ত্রই সফল হতে দেবে না।”
তিনি আরও যোগ করেন যে, বিএনপি সবসময়ই প্রকৃত সংস্কারের ধারক এবং বাহক হিসেবে কাজ করেছে। ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনাই এখন দলটির মূল লক্ষ্য।
শেখ হাসিনার বিচার ও ভারতের ভূমিকা
সম্প্রতি ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনার বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার প্রদান এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে মির্জা ফখরুল উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি ভারত সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেন, শেখ হাসিনাকে অবিলম্বে দেশে ফেরত পাঠানো উচিত। তার মতে, গত দেড় দশকে দেশে সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধ ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের জন্য তাকে অবশ্যই বাংলাদেশের আইনের মুখোমুখি হতে হবে। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সময়ের দাবি বলে তিনি মনে করেন।
উপসংহার ও ভবিষ্যৎ পথরেখা
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এই বক্তব্য মূলত বাংলাদেশে দ্রুত একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তাকেই পুনর্ব্যক্ত করে। তিনি মনে করেন, দীর্ঘায়িত অন্তর্বর্তীকালীন শাসনব্যবস্থা নানা প্রকার দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। তাই সব রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের সমন্বয়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করাই এখন প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।
বিএনপির এই অবস্থান থেকে এটি স্পষ্ট যে, তারা মাঠপর্যায়ে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক কাঠামোর স্বপ্ন দেখছে, যেখানে সংবিধান ও জনগণের ইচ্ছাই হবে চূড়ান্ত।
