হরনাথ বাইন ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিবিদ, সমাজসংগঠক এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অন্যতম সাহসী সংগঠক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারাবাহিকতা—১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত—যাদের নিরলস শ্রম, সাহসিকতা ও নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, হরনাথ বাইন ছিলেন সেই নীরব সৈনিকদের একজন, যাঁরা ইতিহাসে অনেকটা আড়ালে থেকেও অসামান্য ভূমিকা রেখে গেছেন।
তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য, স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম জাতীয় সংসদের নির্বাচিত সংসদ সদস্য, এবং ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এক অবিচল আদর্শের ধারক।
Table of Contents
জন্ম ও শৈশব: মাটি ও মানুষের কাছাকাছি এক জীবন
হরনাথ বাইন জন্মগ্রহণ করেন বরিশাল জেলার উজিরপুর উপজেলার সাতলা ইউনিয়নের সাতলা গ্রামে।
এই অঞ্চল তার রাজনৈতিক ও সামাজিক দর্শনের ভিত্তি নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গ্রামের সাধারণ মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক, কৃষক-শ্রমিকের জীবনসংগ্রাম, ও সমাজের প্রান্তিক মানুষের দুঃখ-দুর্দশা কাছ থেকে দেখে তিনি রাজনীতিতে মানুষের অধিকারের কথা বলতে শিখেছিলেন।
তাঁর শিক্ষা ও শৈশব সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া না গেলেও তাঁর কর্মকাণ্ড, আদর্শ ও আন্দোলনে অংশগ্রহণ তার তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার সাক্ষ্য বহন করে।
রাজনৈতিক জীবন: ভাষা থেকে স্বাধীনতা—এক সুদীর্ঘ পথচলা
▸ ভাষা আন্দোলনের অগ্রণী কর্মী (১৯৫২)
হরনাথ বাইন ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবিতে অনুষ্ঠিত ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এই আন্দোলন তাকে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছিল।
তিনি ছিলেন সেই প্রজন্মের প্রতিনিধি, যারা শুধু কাগজে-কলমে রাজনীতি করতেন না, বরং রাজপথে থাকতেন জনগণের পাশে।
▸ ছয় দফা আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান (১৯৬৬–৬৯)
বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপরেখা তৈরি হয় ১৯৬৬ সালের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা দাবির মাধ্যমে, যা হরনাথ বাইন অকুণ্ঠ সমর্থন ও মাঠপর্যায়ে সংগঠনের মাধ্যমে বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখেন।
পরে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানেও তিনি সক্রিয় থাকেন, যা পাকিস্তানি সামরিক একনায়কত্বের বিরুদ্ধে একটি মোড় ঘোরানো মুহূর্ত ছিল।
▸ মুক্তিযুদ্ধকালীন সংগঠক হিসেবে ভূমিকা (১৯৭১)
হরনাথ বাইন ছিলেন ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন সক্রিয় সংগঠক।
বরিশাল ও দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন, স্থানীয় পর্যায়ে শরণার্থী সহায়তা, গোপন বৈঠক, সংবাদ আদান-প্রদান ও প্রতিরোধ গঠনে মুখ্য ভূমিকা রাখেন।
তিনি সরাসরি অস্ত্রধারণ না করলেও যুদ্ধ সংগঠনের কাজে তার কৌশলী অবদান ছিল অপরিসীম।
প্রাদেশিক পরিষদ থেকে জাতীয় সংসদ: রাজনৈতিক নেতৃত্বের উজ্জ্বল উদাহরণ
▸ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য
স্বাধীনতার আগে তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি স্থানীয় উন্নয়ন, কৃষিনির্ভর অর্থনীতি এবং শিক্ষার প্রসারে নীতিনির্ধারণী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন।
▸ ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে, তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বাকেরগঞ্জ-১২ আসন থেকে জয়ী হন।
এটি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গণতান্ত্রিক সংসদ, যেখানে তিনি দেশ পুনর্গঠনে আইন প্রণয়ন ও নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
▸ ১৯৯১ সালের নির্বাচন
বহু বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল-২ আসন থেকে পরাজিত হন, তবে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছিল গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতায় তাঁর অবিচল থাকার প্রমাণ।
নির্বাচনী তথ্যসারণি
| নির্বাচন সাল | আসন | দল | ফলাফল |
| ১৯৭৩ | বাকেরগঞ্জ-১২ | বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ | বিজয়ী |
| ১৯৯১ | বরিশাল-২ | বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ | পরাজিত |
অবদান, আদর্শ ও উত্তরাধিকার
হরনাথ বাইনের রাজনৈতিক জীবন ছিল এক সত্যনিষ্ঠ সংগ্রামী ধারার প্রতিচ্ছবি। তিনি ছিলেন সেই দুর্লভ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যিনি জনসংযোগে নয়, আদর্শ ও কর্মকাণ্ডে মানুষকে সঙ্গে নিয়েছেন। তিনি যে কোনো নির্বাচনে জয়ী হোন বা না হোন, তার অবস্থান ছিল সর্বদা মানুষের অধিকার, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতির উন্নয়নের পক্ষে।

হরনাথ বাইন ছিলেন এক অসাধারণ নীরব যোদ্ধা—যার রাজনৈতিক জীবন ছিল ত্যাগ, নিষ্ঠা ও দেশপ্রেমে পূর্ণ। তার কর্মজীবন, আদর্শ এবং নেতৃত্ব আজকের বাংলাদেশে রাজনৈতিক সচেতনতা ও নৈতিকতার জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যারা গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধ, এবং মানুষের অধিকারের জন্য কাজ করতে চান, তাদের জন্য হরনাথ বাইন একটি প্রেরণার নাম, একটি জীবনদর্শন।
