বিনোদন জগতের আলোচিত ও বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব আশরাফুল আলম, যিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘হিরো আলম’ নামে সমধিক পরিচিত, আবারও আইনি জটিলতায় আবর্তিত হয়েছেন। এবার তাঁর বিরুদ্ধে এবং তাঁর সহযোগী আহসান হাবিব সেলিমের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে বিজ্ঞ আদালত। গত ১২ নভেম্বর, বুধবার, ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের বিচারক ওয়াহিদুজ্জামান এই কঠোর আদেশ প্রদান করেন। হিরো আলমের স্ত্রী রিয়া মনির দায়ের করা একটি মামলার প্রেক্ষিতে এবং জামিনের শর্ত লঙ্ঘনের অভিযোগে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
Table of Contents
আইনি কার্যক্রম ও আদালতের পর্যবেক্ষণ
আদালত সূত্রে জানা গেছে, হিরো আলম ও আহসান হাবিব সেলিম ইতিপূর্বে এই মামলায় জামিনে ছিলেন। তবে গত বুধবার শুনানির সময় বাদীপক্ষের আইনজীবী জিয়াউর রহমান চৌধুরী আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানান যে, আসামিরা নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন না এবং জামিনের শর্তাবলি বারবার ভঙ্গ করছেন। আইন অনুযায়ী, জামিনপ্রাপ্ত কোনো আসামি যদি আদালতের নির্দেশ অমান্য করেন বা বিচার প্রক্রিয়ায় অসহযোগিতা করেন, তবে তাঁর জামিন বাতিলযোগ্য।
বাদীপক্ষের আইনজীবীর এই আবেদনের গুরুত্ব বিবেচনা করে এবং আসামিদের অনুপস্থিতির প্রেক্ষিতে বিচারক তাঁদের জামিন বাতিল করেন এবং তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির নির্দেশ দেন। এই আদেশের ফলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য আসামিদের গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করার আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে।
মামলার নেপথ্য কাহিনী ও অভিযোগের বিবরণ
এই আইনি লড়াইয়ের সূত্রপাত হয়েছিল চলতি বছরের জুন মাসে। হিরো আলমের স্ত্রী রিয়া মনি বাদী হয়ে রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় এই মামলাটি দায়ের করেন। মামলার এজাহারে অত্যন্ত গুরুতর সব অভিযোগ আনা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে হত্যাচেষ্টা, শারীরিক নিগ্রহ, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং চুরির মতো অপরাধ।
রিয়া মনির ভাষ্যমতে, হিরো আলমের সাথে তাঁর পারিবারিক সম্পর্ক বেশ কিছুদিন ধরেই তিক্ততার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। অশান্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছালে হিরো আলম তাঁকে তালাক প্রদান করেন এবং জোরপূর্বক বাসা থেকে বের করে দেন। পরবর্তীতে গত ২১ জুন, হাতিরঝিল থানা এলাকার একটি বাসায় এই পারিবারিক বিবাদ মীমাংসার লক্ষ্যে একটি ঘরোয়া বৈঠকের আয়োজন করা হয়। রিয়া মনি তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন।
অভিযোগ করা হয়েছে যে, সেই বৈঠকে হিরো আলম ও আহসান হাবিব সেলিমের নেতৃত্বে ১০-১২ জন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি রিয়া মনি ও তাঁর পরিবারের ওপর চড়াও হন। তাঁরা অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করার পাশাপাশি দেশীয় অস্ত্র ও কাঠের লাঠি দিয়ে রিয়া মনিকে মারধর করেন। এই হামলায় রিয়া মনি শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতপ্রাপ্ত হন এবং রক্তাক্ত জখম হন। শুধু তাই নয়, বাদীর অভিযোগ অনুযায়ী, ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে হিরো আলম তাঁর গলা থেকে দেড় ভরি ওজনের একটি স্বর্ণের চেইন ছিনিয়ে নিয়ে যান। এই ঘটনার দুদিন পর, অর্থাৎ ২৩ জুন রিয়া মনি বাদী হয়ে থানায় মামলাটি রুজু করেন।
মামলার সারসংক্ষেপ ও বর্তমান পরিস্থিতি
হিরো আলমের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত এই মামলার প্রধান দিকগুলো নিচের সারণিতে সংক্ষিপ্ত আকারে উপস্থাপন করা হলো:
| বিষয় | বিস্তারিত তথ্য |
| প্রধান আসামি | আশরাফুল আলম (হিরো আলম) ও আহসান হাবিব সেলিম। |
| মামলার বাদী | রিয়া মনি (হিরো আলমের স্ত্রী)। |
| সংশ্লিষ্ট থানা | হাতিরঝিল থানা, ঢাকা। |
| ঘটনার তারিখ | ২১ জুন ২০২৫। |
| মামলার প্রধান অভিযোগসমূহ | হত্যাচেষ্টা, মারধর, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও স্বর্ণালঙ্কার চুরি। |
| আদালতের সর্বশেষ আদেশ | জামিন বাতিল ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি। |
| আইনি ধারা | নারী ও শিশু নির্যাতন এবং দণ্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারা। |
সামাজিক প্রভাব ও জনমনে প্রতিক্রিয়া
হিরো আলম বরাবরই তাঁর বিচিত্র কর্মকাণ্ড ও রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে গণমাধ্যমের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন। তবে এবার ব্যক্তিগত জীবনের এই সহিংস রূপ সামনে আসায় তাঁর ভক্ত ও সমালোচকদের মধ্যে ব্যাপক মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। একজন জনপরিচিত ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে তাঁর নিজ স্ত্রীর পক্ষ থেকে এমন গুরুতর অভিযোগ ওঠা সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়কেই নির্দেশ করে বলে মনে করছেন সমাজতাত্ত্বিকরা।
বিশেষ করে পারিবারিক কলহ নিরসনে আলোচনার পরিবর্তে পেশিশক্তির ব্যবহার এবং চুরির মতো অভিযোগ হিরো আলমের ভাবমূর্তিকে বড় ধরনের সংকটের মুখে ফেলেছে। ইতিপূর্বে তিনি বিভিন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আলোচনায় এলেও, আইনি কাঠগড়ায় তাঁর এই অবস্থান তাঁর রাজনৈতিক ও পেশাগত ক্যারিয়ারের জন্য অশনিসংকেত হতে পারে।
পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর এখন পুলিশের দায়িত্ব হলো আসামিদের অবস্থান শনাক্ত করে তাঁদের আইনের আওতায় আনা। যদি আসামিরা স্বেচ্ছায় আদালতে আত্মসমর্পণ না করেন, তবে পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করে রিমান্ডের আবেদন করতে পারে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ঘটনার দিন ওই বাসায় উপস্থিত থাকা সাক্ষীদের জবানবন্দি এবং পারিপার্শ্বিক প্রমাণাদি সংগ্রহের কাজ চলছে। স্বর্ণের চেইন উদ্ধার এবং হামলার পেছনের প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটনে পুলিশি তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
পরিশেষে বলা যায়, হিরো আলমের এই মামলাটি এখন কেবল একটি পারিবারিক বিবাদ নয়, বরং একটি ফৌজদারি অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ায় রূপ নিয়েছে। আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান—আদালতের এই কঠোর বার্তাটিই পরোয়ানা জারির মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে। রিয়া মনি তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং সুষ্ঠু বিচার পেতে প্রশাসনের কাছে আকুল আবেদন জানিয়েছেন। এখন দেখার বিষয়, আইনি লড়াইয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হিরো আলম আগামী দিনগুলোতে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
