হিটলার কোন দেশের অধিবাসী ছিলেন, জার্মানিতে হিটলারের জন্মদিন পালন নিয়ে উত্তেজনা

আডলফ হিটলার ছিলেন অস্ট্রীয় বংশোদ্ভূত একজন জার্মান রাজনীতিবিদ, যিনি বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেয়েছেন। তিনি ছিলেন ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি (NSDAP), যা নাৎসি পার্টি নামে অধিক পরিচিত, এর নেতা। ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তিনি জার্মানির চ্যান্সেলর এবং ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত দেশের একনায়ক হিসেবে ‘ফিউরার’ (Führer) পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

 

google news
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

 

শৈশব, উত্থান নাৎসিবাদের সূচনা

১৮৮৯ সালের ২০ এপ্রিল, অস্ট্রিয়ার ইন নদীর তীরে অবস্থিত ব্রাউনাউ অ্যাম ইন শহরে হিটলারের জন্ম। শৈশবে চিত্রশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন থাকলেও ভিয়েনা একাডেমিতে বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হন। পরে তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং যুদ্ধপরবর্তী হতাশাগ্রস্ত জার্মান জনগণের ক্ষোভকে পুঁজি করে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।

১৯২3 সালে ব্যর্থ বিয়ার হল পুচের পর কারাবরণ করেন, যেখানে তিনি বিখ্যাত বই ‘Mein Kampf’ (আমার সংগ্রাম) রচনা করেন। এই বইতে তাঁর জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ববাদ, ইহুদি বিদ্বেষ এবং জার্মান জাতির ‘নতুন জন্ম’-এর স্বপ্নের কথা বিবৃত হয়।

ক্ষমতা গ্রহণ একনায়কতন্ত্রের নির্মাণ

১৯৩৩ সালে হিটলার চ্যান্সেলর নিযুক্ত হন। এরপর দ্রুতই গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। বিরোধীদল, সমাজতন্ত্রী, বুদ্ধিজীবী ও ইহুদি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এক নিষ্ঠুর দমননীতির সূচনা হয়। সংবাদপত্র ও শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে একটি প্রোপাগান্ডা-নির্ভর সমাজ গড়ে তোলেন।

বিশ্বব্যাপী ধ্বংসযজ্ঞের সূচনা ঘটে তাঁর নেতৃত্বে, যা মানব ইতিহাসে চরম নৃশংসতার এক নতুন সংজ্ঞা গড়ে তোলে।

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ গণহত্যা: হিটলারের নৃশংস উত্তরাধিকার

১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর, হিটলারের নির্দেশে জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করে, যার ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটে। ছয় বছরব্যাপী এই যুদ্ধ বিশ্ববাসীর জন্য এক গভীর দুঃস্বপ্ন হয়ে ওঠে।
প্রায় কোটি মানুষ প্রাণ হারায় এই সংঘাতে। যুদ্ধের সবচেয়ে নৃশংস দিক ছিল হিটলারের পরিকল্পিত ‘হোলোকাস্ট’— যেখানে ইউরোপজুড়ে প্রায় ৬০ লাখ ইহুদিকে গণহত্যার শিকার করা হয়। গ্যাস চেম্বার, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প এবং নাৎসি শিবিরগুলো ভয়াবহ এক বাস্তবতার প্রতীক হয়ে আজও মানুষের মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়।

১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল, বার্লিনে সোভিয়েত বাহিনীর অগ্রগতির মুখে হিটলার বাংকারে আত্মহত্যা করেন। এর মধ্য দিয়ে নাৎসি শাসনের অবসান ঘটে।

 

সমকালীন প্রতিচ্ছবি: হিটলারের জন্মদিন ঘিরে নতুন বিতর্ক

বর্তমান সময়ে, নাৎসিবাদের আদর্শকে অনুসরণকারী কিছু উগ্র গোষ্ঠী আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সম্প্রতি জার্মানি, পোল্যান্ড ও চেক প্রজাতন্ত্রের কিছু চরমপন্থী নব্য নাৎসি সংগঠন মিলে হিটলারের জন্মদিন (২০ এপ্রিল) পালন করার পরিকল্পনা নেয়।

এই উপলক্ষে জার্মানি-পোল্যান্ড সীমান্তবর্তী অস্ট্রিৎজ শহরে আয়োজন করা হয়েছে দুই দিনব্যাপী কনসার্ট, মার্শাল আর্ট প্রদর্শনী প্রোপাগান্ডা মূলক কর্মসূচি। যদিও আয়োজকরা সরাসরি হিটলারের জন্মদিন পালনের কথা স্বীকার করেনি, তবে স্থানীয় প্রশাসন ও নাগরিক সমাজ একে ‘ছদ্মবেশী নাৎসি সম্মেলন’ হিসেবে দেখছে।

সাক্সোনি রাজ্যের এই আয়োজন ঘিরে সমগ্র জার্মানিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা, মানবাধিকার সংস্থা ও রাজনৈতিক নেতারা শান্তির জন্য উৎসব পালনের ঘোষণা দিয়েছেন প্রতিবাদ হিসেবে।
আশপাশের ৪০টি শহরের মেয়র এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন:

“অস্ট্রিৎজ কিংবা অন্য কোথাও নব্য নাৎসিদের কোনো সভা-সমাবেশ মেনে নেওয়া যায় না। যারা মানবতা ও গণতন্ত্রকে পদদলিত করে স্বৈরতন্ত্রের জয়গান গায়, তাদের আমরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি।”

 

নাৎসিবাদ নব্য নাৎসি তৎপরতা: এক অন্তর্নিহিত হুমকি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, জার্মানিতে নাৎসি পতাকা, চিহ্ন এবং দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে আজও কিছু চরম ডানপন্থী গোষ্ঠী নব্য নাৎসি হিসেবে সক্রিয়, যারা জাতিগত বিদ্বেষ, অভিবাসনবিরোধী মনোভাব এবং ঐতিহাসিক বিকৃতির মাধ্যমে সমাজে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা চালায়।

বিশেষ করে ১৯৯০ সালের পর সাক্সোনি রাজ্যের অস্ট্রিৎজ, গার্টলিস ও বাউটসেন অঞ্চলে নব্য নাৎসিদের ঘন ঘন সমাবেশ ও সহিংস কর্মকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

অস্ট্রিৎজ শহরজুড়ে এখন উচ্চ নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। দেশজুড়ে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন, গোয়েন্দা নজরদারি এবং আগতদের নিবন্ধন কার্যক্রম চালু রয়েছে।

 

অতীতের শিক্ষা ভবিষ্যতের চেতনা

আডলফ হিটলার শুধুই একজন রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না; তিনি ইতিহাসের এক ভয়াবহ শিক্ষা, যাঁর শাসনকাল মানুষকে দেখিয়েছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কীভাবে বিভ্রান্তি, ঘৃণা ও ধ্বংসের হাতিয়ারে পরিণত হতে পারে।

হিটলারের জন্মদিন পালনের মতো উদ্যোগসমূহ আজও গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ইতিহাসবোধের জন্য হুমকি। এসব ঘটনার মুখোমুখি হয়ে আমাদের বারবার ভাবতে হয়—
আমরা কি সত্যিই অতীত থেকে শিক্ষা নিচ্ছি?”

Leave a Comment