হাসপাতাল থেকে ফিরে নচিকেতার গভীর প্রতিফলন

ডিসেম্বরের শুরুতেই আচমকা বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করে হাসপাতালে ভর্তি হন পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী গায়ক-গীতিকার নচিকেতা চক্রবর্তী। প্রাথমিকভাবে বিষয়টি উদ্বেগজনক হলেও পরবর্তী নানা পরীক্ষায় তাঁর হৃদযন্ত্রে ব্লকেজ ধরা পড়ে। চিকিৎসকদের কড়া নজরদারিতে কয়েকদিন তাঁকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। শারীরিক যন্ত্রণার পাশাপাশি এই সময়টা তাঁর জীবনে এনে দেয় গভীর মানসিক নাড়া। ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি হলে ছয় দিনের চিকিৎসা শেষে ১২ ডিসেম্বর তিনি বাড়ি ফেরেন। তবে হাসপাতালের ওই দিনগুলো শুধুই চিকিৎসার পর্ব ছিল না—তা হয়ে ওঠে জীবন ও মৃত্যুর মুখোমুখি এক তীব্র আত্মসংলাপ।

হাসপাতালের নিঃসঙ্গ মুহূর্তগুলোতে নচিকেতা নিজের ভাবনা, ভয়, অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি লিপিবদ্ধ করতে শুরু করেন। সেখান থেকেই জন্ম নেয় এক শক্তিশালী স্বগতোক্তি— ‘মৃত্যু মস্তো ফাঁকি’। সম্প্রতি সেই লেখাটি তিনি নিজ কণ্ঠে পাঠ করে ভিডিও আকারে ফেসবুকে প্রকাশ করেছেন। ভিডিওটিতে ধরা পড়ে এক অন্য নচিকেতা—অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ, আবেগে ভরা, তীক্ষ্ণ রসবোধে মোড়া, আবার কোথাও কোথাও অভিমানে ক্ষতবিক্ষত।

এই স্বগতোক্তিতে নচিকেতা ফিরে দেখেন জীবনের একাধিক মুহূর্ত, যখন তিনি মৃত্যুর খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন। অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তিনি বলেন, মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে বারবার ফিরে আসায় তাঁর বিশেষ আপত্তি নেই। স্মৃতিচারণায় উঠে আসে কৈশোরে বাইক দুর্ঘটনার পর কোমায় চলে যাওয়ার ঘটনা, রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে এক সহযোদ্ধার মৃত্যু দেখা, পরিত্যক্ত আন্ডারগ্রাউন্ড রেল টানেলে প্রায় ডুবে যাওয়ার অভিজ্ঞতা, এমনকি শৈশবে আত্মহত্যার চেষ্টার কথাও। মাত্র ছয়-সাত বছর বয়সে সমাজ ও রাজনীতির অশান্ত আবহে দেখা কিছু ভয়াবহ দৃশ্য তাঁর মানস গঠনে কীভাবে প্রভাব ফেলেছে, তাও অকপটে জানান তিনি। এর পাশাপাশি ৪৭ বছর বয়সে দিল্লির এক হাসপাতালে জটিল হুইপল সার্জারির মধ্য দিয়ে মৃত্যুকে আবারও ফাঁকি দেওয়ার কথাও উঠে আসে।

তবে এই ভিডিওর সবচেয়ে তীক্ষ্ণ অংশ সম্ভবত সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে তাঁর ক্ষোভ। বছরের পর বছর ধরে ইন্টারনেটে তাঁর মৃত্যুসংবাদ ছড়ানো হয়েছে বারবার। সাম্প্রতিক হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময়ও সেই গুজব নতুন করে মাথাচাড়া দেয়। ব্যঙ্গ আর তিক্ত রসিকতায় নচিকেতা বলেন, তাঁর প্রকৃত আয়ুর চেয়েও বেশি বার সোশ্যাল মিডিয়া তাঁকে ‘মেরে ফেলেছে’। এমনকি ঠাট্টার ছলে তিনি বলেন, পরের বার ইন্টারনেট যদি তাঁকে মৃত ঘোষণা করে, তাহলে হয়তো সেটাই মেনে নেওয়া উচিত—অন্যদের ঝামেলা কমবে!

এই স্বগতোক্তির শেষদিকে নচিকেতা ফিরে যান তাঁর বিখ্যাত গান ‘আগুনপাখি’-র কথায়। সেই গানের দুটি পঙ্‌ক্তির মধ্য দিয়েই তিনি জানিয়ে দেন জীবনের প্রতি তাঁর অটুট অঙ্গীকার—

মৃত্যু শেষ কথা নয়,
চোখে আকাশ, ডানায় আগুন—
এখনও অনেক দূর ওড়া বাকি।

অসুস্থতা, গুজব আর গভীর আত্মবিশ্লেষণের মধ্য দিয়েও নচিকেতা চক্রবর্তী স্পষ্ট করে দেন—এই অধ্যায়েই তাঁর গল্প শেষ নয়। গান যেমন চলবে, তেমনই চলবে জীবনও।