হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ । বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ

হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ (জন্ম: ২৯ অক্টোবর ১৯৩৯) বাংলাদেশের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক সেনা কর্মকর্তা, ফুটবল খেলোয়াড়, রাজনীতিবিদ এবং সাবেক মন্ত্রী। তার বর্ণাঢ্য জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি দেশ ও জাতির সেবায় নিবেদিত থেকেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত হন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর ভাইস চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করছেন।

 

জন্ম ব্যক্তিগত জীবন

হাফিজ উদ্দিন আহম্মদের জন্ম ভোলা জেলার লালমোহন উপজেলায়, ১৯৩৯ সালের ২৯ অক্টোবর।
তাঁর পিতা আজহার উদ্দিন আহম্মদ এবং মাতা করিমুন্নেছা
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দিলারা হাফিজকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির তিন সন্তান—এক কন্যা এবং দুই পুত্র।

 

প্রারম্ভিক জীবন সামরিক ক্যারিয়ার

পড়াশোনা শেষ করে হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।
১৯৬৮ সালে কমিশনপ্রাপ্ত হয়ে তিনি প্রথম নিয়োগ পান প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে
শুধু সামরিক জীবনে নয়, তিনি ছিলেন একজন ক্রীড়ামনস্ক ব্যক্তি এবং বাংলাদেশের জাতীয় ফুটবল দলের একজন সদস্য হিসেবেও খেলেছেন।

 

মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতার ইতিহাস

১৯৭১ সালের মার্চে তিনি যশোর অঞ্চলের জগদীশপুর এলাকায় শীতকালীন প্রশিক্ষণে ছিলেন।
২৫ মার্চের গণহত্যার খবর পাওয়ার পর ২৯ মার্চ তারা ইউনিটসহ সেনানিবাসে ফিরে আসেন এবং পরে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।

তিনি অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মুখযুদ্ধে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য—

  • কামালপুর যুদ্ধ (বকশীগঞ্জ, জামালপুর)
  • ধলই বিওপি যুদ্ধ
  • কানাইঘাট যুদ্ধ
  • সিলেটের এমসি কলেজ যুদ্ধ

 

কামালপুরের স্মরণীয় যুদ্ধ:

১৯৭১ সালের ৩১ জুলাই ভোর সাড়ে তিনটায় মুক্তিবাহিনীর বি ডি কোম্পানি কামালপুর বিওপিতে অভিযান শুরু করে।
বি কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ এবং ডি কোম্পানির নেতৃত্বে ছিলেন সালাহউদ্দিন মমতাজ (বীর উত্তম)
যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আর্টিলারি ও মর্টার ব্যবহার করে প্রচণ্ড প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

হাফিজ উদ্দিন এবং সালাহউদ্দিন মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্গঠিত করে প্রবল আক্রমণ চালান এবং শত্রুদের পিছু হটতে বাধ্য করেন।
এই যুদ্ধে সালাহউদ্দিন শহীদ হন এবং হাফিজ উদ্দিন আহত হন মর্টারের স্প্লিন্টারে। দুই কোম্পানি তখন নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে।
এই যুদ্ধ তার সাহস, নেতৃত্ব ও আত্মত্যাগের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে ইতিহাসে।

 

রাজনৈতিক জীবন সংসদ সদস্য পদ

সেনাবাহিনীতে দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালনের পর অবসর গ্রহণ করে হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেন।

  • ১৯৮৬ ১৯৮৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি জাতীয় পার্টির মনোনয়নে ভোলা-৩ (লালমোহন-তজুমদ্দিন) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
  • ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন এবং পরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে (বিএনপি) যোগ দেন।
  • এরপর তিনি ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ (ষষ্ঠ), জুন ১৯৯৬ (সপ্তম) এবং ২০০১ সালের (অষ্টম) জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী হিসেবে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
  • খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় মন্ত্রিসভায় তিনি একজন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

 

পুরস্কার সম্মাননা

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শনের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাকে ‘বীর বিক্রম’ উপাধিতে সম্মানিত করে।
এই খেতাব বাংলাদেশের বীরত্বপূর্ণ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তৃতীয় সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান, যা সাহসিকতা ও নেতৃত্বের অনন্য স্বীকৃতি।

 

google news
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ একজন বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব—তিনি একাধারে দেশপ্রেমিক সৈনিক, সম্মুখযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী মুক্তিযোদ্ধা, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতা। তার জীবন ও কর্ম আগামী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা এবং ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে থাকবে।

Leave a Comment