সুফি, সৈনিক ও স্বাধীনতা—দেওয়ানবাগীর ভুলে যাওয়া রণগাথা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যতবার আলোচিত হয়, ততবারই পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে এই যুদ্ধ শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বের নয়; এটি ছিল বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম, যেখানে কৃষক, ছাত্র, ধর্মীয় আলেম, শিক্ষকসহ সমাজের প্রতিটি শ্রেণির মানুষ জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সে ধারাবাহিকতায় এক বিশেষ নাম—মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী—যিনি পরবর্তীতে ধর্মীয় অঙ্গনে ‘সুফি সম্রাট’ হিসেবে পরিচিতি পেলেও ১৯৭১ সালে ছিলেন এক অসীম সাহসী প্লাটুন কমান্ডার।

সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি গানের কলি—“একাত্তরের সেই মুক্তিযুদ্ধতে, সুফি সম্রাট দেওয়ানবাগী…”—অনেককে হাস্যরসের উপলক্ষ এনে দিয়েছে। কিন্তু ইতিহাসের দলিল খুলে দেখলে হাসির আড়াল সরিয়ে বেরিয়ে আসে এক ভিন্ন, প্রায় অজানা বাস্তবতা—দেওয়ানবাগী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখসমরে অংশ নেওয়া প্রশিক্ষিত ও নথিভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা।

রাজনৈতিক চেতনার মজবুত ভিত

দেওয়ানবাগীর যুদ্ধযাত্রা কোনো হঠাৎ সিদ্ধান্ত ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের আগেই তার রাজনৈতিক চেতনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পশ্চিমাঞ্চলে ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’-এর সভাপতি হিসেবে নেতৃত্ব দেন তিনি। ১৯৭০-এর নির্বাচনের পর যখন পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র প্রকট হয়, তখন তিনি ছাত্রদের সংগঠিত করতে শুরু করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সম্ভাব্য পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নেন। ২৫ মার্চের গণহত্যার পর তার সেই প্রস্তুতি বাস্তব রূপ পায়।

শরণার্থী সহায়তা থেকে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি

ক্র্যাকডাউনের পর তিনি প্রথমে স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করে শরণার্থীদের সহায়তায় নেমে পড়েন। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতা ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দেখে তিনি উপলব্ধি করেন, কেবল মানবিক সহায়তা যথেষ্ট নয়। দেশকে মুক্ত করতে হলে অস্ত্র ধরতেই হবে। তাই তিনি সরাসরি যোগ দেন সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধে।

৩ নম্বর সেক্টরের প্লাটুন কমান্ডার

১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল তিনি ৭২ জন তরুণকে সঙ্গে নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেড্ডা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যোগ দেন। এরপর যান তেলিয়াপাড়া হেডকোয়ার্টারে, যেখানে তাকে নির্বাচিত ৬০ জন যোদ্ধার একটি প্লাটুনের নেতৃত্বভার দেওয়া হয়। ভারতীয় নথিতে তার ক্রমিক নম্বর এমএফ ভলিউম–৭, পৃষ্ঠা–১১ এবং বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের নথিতে তার নম্বর ৩৪০৬৬—যা তার অংশগ্রহণের সরকারি প্রমাণ।

সম্মুখসমরের বীরত্ব

২৬ এপ্রিল শাহবাজপুরে তার নেতৃত্বে প্রথম সফল অ্যাটাক পরিচালিত হয়। এরপর মে মাসজুড়ে তিনি একের পর এক অ্যামবুশ পরিচালনা করেন—১১ মে সিলেট–ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহাসড়ক, ১২ মে বাগসাইর, ১৬ মে তেলিয়াপাড়া–চুনারুঘাট, ১৫ জুন মনতলা–হরষপুর—প্রতিটি অপারেশনে তাকে সম্মুখভাগেই দেখা যায়।

এক পর্যায়ে কৌশলগত কারণে তাকে ১ নম্বর সেক্টরে পাঠানো হয়, যেখানে তিনি মেজর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে কাজ করে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠনে সহায়তা করেন।

কমিশন প্রত্যাখ্যান—এক অনন্য ত্যাগ

যুদ্ধের মাঠে তার নেতৃত্ব ও দক্ষতা দেখে সেনাপতি এম এ জি ওসমানী তাকে নিয়মিত বাহিনীতে কমিশনড অফিসার পদে যোগদানের প্রস্তাব দেন। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তার বক্তব্য ছিল:
“আমি যুদ্ধে এসেছি দেশকে মুক্ত করতে, পেশা গড়তে নয়।”

এই প্রত্যাখ্যান ছিল ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠা এক নিখাদ দেশপ্রেমিক সৈনিকের পরিচয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণাদাতা আলেম

শুধু অস্ত্রধারী যোদ্ধা নয়, তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণার উৎসও। পাকিস্তানি বাহিনী ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে গণহত্যা চালালেও দেওয়ানবাগী যোদ্ধাদের মনে করিয়ে দিতেন—অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করাই প্রকৃত জিহাদ।

হেজামারার ঈদ জামাত ও বিস্ময়কর ভবিষ্যদ্বাণী

১৯ নভেম্বর ১৯৭১, ভারতের হেজামারা ক্যাম্পে ঈদের খুতবায় তিনি ঘোষণা করেন—
“আগামী বকরার ঈদের আগেই বাংলাদেশ স্বাধীন হবে।”
তৎকালীন সেক্টর কমান্ডার সফিউল্লাহ ও সুবিদ আলী ভূঁইয়া তাদের গ্রন্থে এই ঘটনাকে নিশ্চিত করেছেন। অলৌকিকভাবে হলেও সত্য—তার ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তব হয়। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে তিনি ঢাকার রেসকোর্সে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ঈদুল আজহার জামাতে ইমামতি করেন।

ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে মূল্যায়ন

দেওয়ানবাগীর তরিকত চর্চা ও ভাবধারাকে ঘিরে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু তার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় বিতর্কাতীত। তিনি প্রমাণ করেছেন—সুফি মানে শুধু ধ্যান–মগ্নতা নয়; অন্যায়ের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেওয়াও একজন মুমিনের দায়িত্ব।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ট্রল কিংবা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ বাস্তব ইতিহাসকে বদলে দিতে পারে না। একাত্তরের রণাঙ্গনে দেওয়ানবাগীর অবদান স্বাধীনতার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা সম্মান ও স্বীকৃতির দাবিদার।