সাহিত্যে মনস্তত্ত্বের ব্যবহার [ The use of psychology in literature ] – আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] : আগেকার দিনে মানুষ ঘরোয়া ও সামাজিক জীবনে সহাবস্থানের প্রয়োজনে কতকগুলো নিয়মনীতি ও আদর্শের বাঁধনে নিজেদের জীবন নিয়ন্ত্রিত করত। এবং ঐ নীতি আদর্শের কাঠামোর মধ্যেই তাদের শিল্প–সাহিত্যাদির প্রায় সব কলাই রূপায়িত হত। তাই পূর্বকালে ন্যায়–অন্যায় বা ভালোমন্দ প্রতিপাদন উদ্দেশ্যেই সাধারণত সাহিত্য রচিত হত। ফলে সেকালের ছাঁচে–ঢালা সাহিত্য ছিল ঘটনাপ্রধান, অর্থাৎ বাহ্য ঘটনা ও আচরণের স্থূলচিত্র দানই ছিল লক্ষ্য। মানুষের মন তেমন গুরুত্ব পেত না।
[ সাহিত্যে মনস্তত্ত্বের ব্যবহার – আহমদ শরীফ ]
![সাহিত্যে মনস্তত্ত্বের ব্যবহার [ The use of psychology in literature ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 2 আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature](https://bn.glive24.com/wp-content/uploads/2025/03/আহমদ-শরীফ-Ahmed-Sharif-educationist-philosopher-critic-writer-and-scholar-of-medieval-Bengali-literature-1.jpg)
তাই রস বলতে শৃঙ্গারাদি নানা রসের সমাবেশ থাকত বটে, কিন্তু জীবনরস থাকত স্বল্প ও গৌণ। তবু সেকালের কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন লিখিয়েরা স্ব স্ব জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি দিয়ে চরিত্রের মনের সঙ্গে বাহ্যাচরণের সঙ্গতি রক্ষার চেষ্টা করতেন। এতেই তাঁদের রচনা কালজয়ী উৎকর্ষ লাভ করত। শেক্সপিয়ার, ভিক্টর হুগো, মোপাসাঁ, ডিকেন্স কিংবা ডস্টয়েভকি প্রভৃতি অনেকেই তাই লোকবন্দ্য শিল্পী।
মেঘ–বৃষ্টি–রোদ, সুবাস দুর্বাস, সুন্দর কুৎসিত, লোভ–ক্ষোভ–অসূয়া কিংবা আরাম আনন্দ–আকর্ষণ যে মানুষের মন ও আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে বা মানুষের শারীরিক, মানসিক ও প্রাতিবেশিক অবস্থান যে মানুষের ভাব–চিন্তা–কর্ম নিয়ন্ত্রণ করে; ফ্রয়েডীয় বা এখনকার মনোবিজ্ঞান না জেনেও তাঁরা তা বুঝেছিলেন। মন ও বাহ্যাচরণের মধ্যে যে কারণ–ক্রিয়া সম্বন্ধ রয়েছে, তা সেকালে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করা সম্ভব ছিল না বটে, কিন্তু মানুষ সহজবুদ্ধি দিয়ে তা বুঝত। এজন্য সাহিত্যে–শিল্পে যা অস্বাভাবিক, যা পারিবেশিক কারণে অসঙ্গত, তা কখনো লোকগ্রাহ্য হত না।
![সাহিত্যে মনস্তত্ত্বের ব্যবহার [ The use of psychology in literature ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 3 আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature](https://bn.glive24.com/wp-content/uploads/2025/03/আহমদ-শরীফ-Ahmed-Sharif-educationist-philosopher-critic-writer-and-scholar-of-medieval-Bengali-literature-2.jpg)
ফ্রয়েড মানুষের অবচেতন প্রবৃত্তি ও যৌনবোধকে আত্যন্তিক গুরুত্ব দিয়ে এই শতকে এক নতুন তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করলেন। বিভিন্ন প্রতিবেশে অবদমিত মনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার বিস্ময়কর সব তত্ত্ব ও তথ্য উদ্ঘাটন করে একালের মানুষকে তিনি মাতিয়ে দিলেন। বৃত্তি–প্রবৃত্তির লীলার সে–চমকপ্রদ তথ্য ও তত্ত্ব আধুনিক মানুষের মন হরণ করল। আর এই তত্ত্বের প্রয়োগে মানুষের ভাব–চিন্তা–কর্ম ও আচরণের ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণ দেয়ার ও তাৎপর্য নিরূপণের প্রবণতা প্রায় সব লিখিয়ের মধ্যে অল্পবিস্তর দেখা দিল। আজ যদিও ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের যাথার্থ্য তর্কাতীত নয় এবং অন্য মনোবিজ্ঞানীরা নতুনতর এবং বিশুদ্ধতর তথ্য আবিষ্কারের দাবিদার, তবু সাহিত্যশিল্প–ক্ষেত্রে নতুন জীবনদৃষ্টি প্রাপ্তির জন্য এবং নতুন যুগ সৃষ্টির জন্য আঁকিয়ে লিখিয়েরা ফ্রয়েডের কাছে অপরিশোধ্যভাবে ঋণী।
![সাহিত্যে মনস্তত্ত্বের ব্যবহার [ The use of psychology in literature ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 4 google news](https://bn.glive24.com/wp-content/uploads/2023/01/google-news.jpg)
এমনি করে পুরোনো বিশ্বাস–সংস্কারসংলগ্ন জীবন–প্রত্যয় গেল উবে। নতুন প্রত্যয়–প্রসূত জীবনজিজ্ঞাসা ও জীবনদৃষ্টি যে–মূল্যবোধ জাগাল, যে–সংস্কৃতির জন্ম দিল, তাতে সেকাল ও একালের যোগসূত্রটি গেল হারিয়ে। ফলে বহুযুগের অভ্যস্ত নিয়মনীতি ও মূল্যবোধ ঐ নবচেতনার অভিঘাতে বিপর্যস্ত হয়ে গেল; পুরোনো মানুষ নতুনের সঙ্গে তাল রেখে চলতে পারল না। তাই চেতনার এ বিপ্লবকে তারা মনে করল উপদ্রব, তরুণদের জানল সামাজিক উপসর্গ বলে, বিপ্লব হল উপপ্লব। পরিবর্তমান সমাজের এ অসঙ্গতি ও দ্রোহ সনাতন নিয়ম–নিশ্চিত নিস্তরঙ্গ জীবনে আনল এক অনিশ্চয়তা—যা সনাতনীরা চিহ্নিত করল বৈনাশিক বিচলন বলে।
![সাহিত্যে মনস্তত্ত্বের ব্যবহার [ The use of psychology in literature ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 5 আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature](https://bn.glive24.com/wp-content/uploads/2025/03/আহমদ-শরীফ-Ahmed-Sharif-educationist-philosopher-critic-writer-and-scholar-of-medieval-Bengali-literature-3.jpg)
তবু সামাজিকভাবে মানুষের জীবনে এল প্রগতি, আত্মা হল উন্নত, বিবেক হল প্রবল, সংস্কৃতি পেল উৎকর্ষ। কেননা, রক্তমাংসের মানুষ এই প্রথম জৈবজীবনকে অকপটে স্বীকার করে নিল। মানুষ যে নিয়মনীতি–আদর্শের আদলে গড়া পুতুল নয়, তার যে বোধবুদ্ধির বিকাশ ও বৈচিত্র্য রয়েছে, এক–একটি মানুষ যে এক–একটি স্বতন্ত্র জগৎ এবং সে–জগৎ–যে বরণ–বিচ্যুতি ও ভালোমন্দ নিয়েই সামগ্রিক সত্তায় একটি বিশিষ্ট আশ্চর্য সৃষ্টি, তা এ–যুগে প্রথম সাধারণভাবে স্বীকৃতি পেল।
আগেকার দিনে মানুষকে নিছক ভালো কিংবা অবিমিশ্র মন্দ বলে চিহ্নিত করা হত। সাহিত্যে নিখুঁত ন্যায় ও নির্ভেজাল অন্যায়ই কেবল দেখতে পেতাম। ফলে সদুদ্দেশ্যেই কৃত্রিম তৌলে মানুষকে যাচাই করতে যেয়ে চিরকাল লক্ষকোটি মানুষকে নির্যাতিত করেছি, হরণ করেছি কত মানুষের বাঁচার অধিকার।
মনোবিজ্ঞান অধ্যয়নের ফলে আজ জেনেছি মানুষের ভাব–চিন্তা–কর্ম বিভিন্ন মানস–কারণ ও প্রতিবেশের প্রসূন। মানুষ তার অনেক কর্ম ও আচরণের ব্যাপারে অবস্থার দাস। স্বভাবেও সে পুরো স্বাধীন নয়। তাই মানুষ ভালোও নয়, মন্দও নয়; কখনো ভালো, কখনো মন্দ, কারো কাছে ভালো, কারো কাছে মন্দ। কারো মিত্র, কারো শত্রু। আপেক্ষিকতার এ বোধে উত্তরণ ঘটেছে বলেই আজ আমরা অধিক সহিষ্ণু, সহজেই ক্ষমাশীল, বেশি প্রীতিপরায়ণ ও সহাবস্থানের অনেক বেশি যোগ্য হয়ে উঠেছি। মানবিক বোধের ও মানববাদের বিকাশ মনস্তত্ত্বজ্ঞানের ফলে দ্রুততর হয়েছে। জগৎ জীবন এবং নর ও নারায়ণ সম্পর্কে এই উদার ও সহিষ্ণু দৃষ্টি ফ্রয়েডীয় বিজ্ঞানের বহুলচর্চার ফলেই সম্ভব হয়েছে।
আমাদের দেশে ত্রিশোত্তর সাহিত্যে ও শিল্পে ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের বহুল প্রয়োগ শুরু হয়। কিন্তু আঁকিয়ে লিখিয়েদের নিষ্ঠ অধ্যয়ন ও আন্তরিক অনুধ্যানের অভাবে প্রয়োগ ও বিশ্লেষণক্ষেত্রে বঙ্কিমের রোহিণী–হত্যার মতো আনাড়িপনার স্বাক্ষরই বেশি দেখা যায়। সুষ্ঠুভবে অধিগত বিদ্যার প্রয়োগ–নৈপুণ্য ক্বচিৎ নজরে পড়ে।
![সাহিত্যে মনস্তত্ত্বের ব্যবহার [ The use of psychology in literature ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 6 কাজী নজরুল ইসলাম এর সাথে আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif](https://bn.glive24.com/wp-content/uploads/2025/03/কাজী-নজরুল-ইসলাম-এর-সাথে-আহমদ-শরীফ-Ahmed-Sharif.jpg)
দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়— রবীন্দ্রনাথের আপদ, রোববার, ল্যাবরেটরি প্রভৃতি বহু গল্পে; ঘরে বাইরে উপন্যাসে; তারাশঙ্করের কালাপাহাড়, পিতাপুত্র, আরোগ্যনিকেতন প্রভৃতি অনেক রচনায়; বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী, আরণ্যক কিংবা বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের নীলাঙ্গুরীয়, রাণুর প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ; মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাগৈতিহাসিক, শৈলজ শিলা, পুতুলনাচের ইতিকথা, মণি। গঙ্গোপাধ্যায়ের রমলা, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর চাঁদের অমাবস্যা কিংবা কাঁদো নদী কাঁদো প্রভৃতি গল্পে–উপন্যাসে এবং সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক প্রভৃতি অনেক তরুণের রচনাতেই মনস্তত্ত্বের সুপ্রয়োগ লক্ষণীয়। এক কথায় আজকের উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয় গল্প–উপন্যাস–লেখকমাত্রেরই উৎকৃষ্ট রচনায় মনস্তত্ত্বের সুসঙ্গত প্রয়োগ দুর্লভ নয়।
![সাহিত্যে মনস্তত্ত্বের ব্যবহার [ The use of psychology in literature ] - আহমদ শরীফ [ Ahmed Sharif ] 1 আহমদ শরীফ, Ahmed Sharif, educationist, philosopher, critic, writer and scholar of medieval Bengali literature](https://bn.glive24.com/wp-content/uploads/2025/03/আহমদ-শরীফ-Ahmed-Sharif-educationist-philosopher-critic-writer-and-scholar-of-medieval-Bengali-literature-8.jpg)