শিক্ষা খাতে উদ্বেগজনক অনিয়ম: দেশে ১১৭২ জাল সনদধারী শিক্ষক, ডিআইএর ২৫৩ কোটি টাকা ফেরত ও কঠোর শাস্তির সুপারিশ

দেশের বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থায় দুর্নীতি ও জালিয়াতির বহুল আলোচিত অধ্যায়ের আরও একটি বড় পরিমাণ উদাহরণ প্রকাশ করলো পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)। সাম্প্রতিক তদন্তে সংস্থাটি এক হাজার ১৭২ জন শিক্ষক-কর্মচারীর সনদ জাল বা অগ্রহণযোগ্য বলে শনাক্ত করেছে, যা দেশের শিক্ষা খাতে পেশাগত নৈতিকতা এবং জবাবদিহিতার চিত্রকে ভিন্নভাবে সামনে নিয়ে এসেছে। শুধু জাল সনদেই থেমে নেই; তারা দীর্ঘ সময় ধরে সরকারি অর্থে বেতন–ভাতা নিয়েছেন, ভুয়া নিয়োগের মাধ্যমে পদ দখল করেছেন এবং বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মে জড়িত ছিলেন। ফলে ২৫৩ কোটি টাকা ফেরত নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

ডিআইএর পরিচালক অধ্যাপক এম এম সহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, পুরো তালিকাটি প্রস্তুত হওয়ার শেষ পর্যায়ে আছে এবং শিগগিরই তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। তিনি বলেন, “জাল সনদধারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া শিক্ষা খাতকে স্বচ্ছ করা সম্ভব নয়।”

ডিআইএর তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহী বিভাগে সবচেয়ে বেশি জাল সনদধারী শিক্ষক শনাক্ত হয়েছে—মোট ৭৭৯ জন। এ সংখ্যা শুধু উদ্বেগজনকই নয়; বরং ওই অঞ্চলে শিক্ষা প্রশাসনের দুর্বলতা ও নিয়োগ–যাচাই ব্যবস্থার বড় ধরনের ভাঙনকে নির্দেশ করে। অন্যদিকে খুলনা বিভাগে ১৭৯ জন, মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরে ১২০ জন, ঢাকা বিভাগে ৭০ জন এবং চট্টগ্রাম বিভাগে ২৪ জনের সনদ জাল বলে প্রমাণিত হয়েছে।

তদন্তে আরও জানা গেছে, ১১৭২ জনের মধ্যে প্রায় ৪০০ জনের সনদ সম্পূর্ণ ভুয়া—অর্থাৎ তারা কোনো স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি অর্জনই করেননি। বাকি ৩০০ জনের সনদ নানা অসঙ্গতি ও জটিলতার কারণে “অগ্রহণযোগ্য” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এরা কেউ কেউ অস্বীকৃত প্রতিষ্ঠান, কেউ ভুয়া বোর্ড, আবার কেউ জাল প্রশংসাপত্র ব্যবহার করেছেন।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই ব্যক্তিরা শুধু চাকরিতে প্রবেশই করেননি; বরং দীর্ঘমেয়াদে সরকারি কোষাগার থেকে কোটি কোটি টাকা বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা নিয়েছেন। ভ্যাট, আইটি এবং আর্থিক নথিপত্রে গুরুতর অনিয়মও পাওয়া গেছে। পুরো অনিয়মের পরিমাণ হিসাব করে ডিআইএ মোট ২৫৩ কোটি টাকা ফেরত নেওয়ার সুপারিশ করেছে—যা দেশের শিক্ষা খাতে আর্থিক জালিয়াতির ইতিহাসে অন্যতম বড় অঙ্ক।

ডিআইএ প্রথম ধাপে ৪০০ জন জাল সনদধারী শিক্ষক-কর্মচারীর তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা, চাকরিচ্যুতি এবং আইনি প্রক্রিয়া শুরু করার সুপারিশও থাকবে। শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ঘটনা উন্নত নিয়োগ ব্যবস্থা, ডিজিটাল সার্টিফিকেট যাচাই এবং শক্তিশালী পরিদর্শন ব্যবস্থার জরুরি প্রয়োজনীয়তাকে আবারো সামনে এনেছে।

শিক্ষা খাতে জাল সনদের প্রসার শুধু আর্থিক ক্ষতিই করেনি; বরং মানসম্মত শিক্ষা বঞ্চিত করেছে অগণিত শিক্ষার্থীকে। অযোগ্য ব্যক্তি যখন শিক্ষকতার মতো পেশায় প্রবেশ করেন, তখন তা শিশুর শেখার দক্ষতাকে দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। সেই অবস্থায় ডিআইএর এই প্রতিবেদন শুধু অনিয়ম চিহ্নিতই করেনি; বরং একটি প্রাতিষ্ঠানিক রোগ নিরাময়ের জন্য প্রয়োজনীয় কঠোরতা ও স্বচ্ছতার দাবি তুলেছে।