দেশের বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে দীর্ঘদিনের উৎকণ্ঠা কাটিয়ে এখন সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (গ্রস রিজার্ভ) আবারও বড় ব্যবধানে বেড়ে ৩২.৭২ বিলিয়ন ডলারের কোটা অতিক্রম করেছে। সোমবার (২২ ডিসেম্বর) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান আনুষ্ঠানিকভাবে এই ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা জানান। বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিরতার মাঝেও দেশের রিজার্ভের এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ী মহলে বড় ধরনের স্বস্তি বয়ে এনেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২২ ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত দেশের মোট গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩২,৭২০.১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি ‘বিপিএম-সিক্স’ অনুযায়ী প্রকৃত রিজার্ভের পরিমাণ এখন ২৮,০৩৬.৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২৮.০৪ বিলিয়ন ডলার। এর মাত্র কয়েক দিন আগে, অর্থাৎ ১৮ ডিসেম্বর গ্রস রিজার্ভ ছিল ৩২,৫৭৩.৩১ মিলিয়ন ডলার। মাত্র চার দিনের ব্যবধানে এই অংক ১৪৬.৮১ মিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পাওয়া দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সফলতাকে ইঙ্গিত করে।
রিজার্ভের বর্তমান পরিস্থিতির একটি স্বচ্ছ পরিসংখ্যান:
| সূচকের বিবরণ | ১৮ ডিসেম্বর (মিলিয়ন ডলার) | ২২ ডিসেম্বর (মিলিয়ন ডলার) | নিট বৃদ্ধি (মিলিয়ন ডলার) |
| মোট গ্রস রিজার্ভ | ৩২,৫৭৩.৩১ | ৩২,৭২০.১২ | + ১৪৬.৮১ |
| বিপিএম-সিক্স রিজার্ভ | ২৭,৮৭৫.৭০ | ২৮,০৩৬.৬০ | + ১৬০.৯০ |
| হিসাব পদ্ধতি | কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজস্ব | আইএমএফ স্ট্যান্ডার্ড | — |
সাধারণত বিপিএম-সিক্স পদ্ধতিটিকেই সারাবিশ্বে একটি দেশের প্রকৃত আর্থিক সক্ষমতার মাপকাঠি হিসেবে ধরা হয়। এই পদ্ধতিতে মোট মজুদ থেকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ বা দায়গুলো বিয়োগ করে প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য ডলারের হিসাব বের করা হয়। বর্তমানের এই রিজার্ভ দিয়ে দেশ অন্তত আগামী ৫ থেকে ৬ মাসের প্রয়োজনীয় আমদানি ব্যয় মেটাতে সক্ষম। বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুযায়ী, তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো সক্ষমতা থাকলেই একটি দেশকে অর্থনৈতিকভাবে নিরাপদ মনে করা হয়, সেই হিসেবে বাংলাদেশ এখন বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বেশ কয়েকটি কারণে রিজার্ভের এই শক্তিশালী অবস্থান তৈরি হয়েছে। প্রথমত, বৈধ পথে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের উচ্চ প্রবাহ রিজার্ভের পালে বাতাস দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, রপ্তানি আয় স্থিতিশীল থাকার পাশাপাশি ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) এবং আইএমএফ থেকে নতুন কিস্তির ঋণ ও বাজেট সহায়তা ছাড় হওয়া। এছাড়াও হুন্ডি প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জিরো টলারেন্স নীতি এবং আমদানিতে বিলাসিতা কমানোর ফলে ডলারের ওপর চাপ অনেক কমে এসেছে।
রিজার্ভের এই মজবুত ভিত্তি আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের ‘ক্রেডিট রেটিং’ উন্নত করতে সরাসরি ভূমিকা রাখবে, যার ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে। বিশেষ করে আসন্ন দিনগুলোতে জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ডলার সংকট মোকাবিলায় এটি বড় সুরক্ষা ঢাল হিসেবে কাজ করবে। তবে স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্য আনা এবং সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
