কলকাতা দিয়ে শুরু, তারপর হায়দরাবাদ, মুম্বাই হয়ে দিল্লি—গত সপ্তাহজুড়ে ভারত সফরে কার্যত দৌড়ের ওপর ছিলেন লিওনেল মেসি। সঙ্গে ছিলেন তাঁর দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ফুটবলসঙ্গী লুইস সুয়ারেজ এবং রদ্রিগো দি পল। ইন্টার মায়ামির এই তিন মহাতারকার ভারত আগমন ঘিরে উন্মাদনা ছিল তুঙ্গে। আয়োজকদের ভাষায়, এটি ছিল সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক সফর—ফুটবল প্রদর্শনী, জনসমাগম এবং ব্র্যান্ড প্রচারের সমন্বয়। কিন্তু মাঠের আনন্দ ছাপিয়ে শেষ পর্যন্ত এই সফর আলোচনায় এসেছে কলকাতার সল্টলেক স্টেডিয়ামে ঘটে যাওয়া নজিরবিহীন বিশৃঙ্খলার জন্য।
সেই বিশৃঙ্খলার রেশ গড়িয়েছে আদালত, পুলিশি তদন্ত ও রাজ্য রাজনীতির অন্দরমহল পর্যন্ত। তদন্ত করতে গিয়েই সামনে এসেছে চমকে দেওয়ার মতো আর্থিক তথ্য। ভারতের বিশেষ তদন্ত দল (এসআইটি) সূত্রে জানা গেছে, পুরো ভারত সফরের জন্য লিওনেল মেসি একাই পারিশ্রমিক হিসেবে পেয়েছেন প্রায় ৮৯ কোটি রুপি। সব মিলিয়ে সফরের মোট ব্যয় ছিল আনুমানিক ১০০ কোটি রুপি। কলকাতার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া প্রধান আয়োজক শতদ্রু দত্তকে জিজ্ঞাসাবাদ করেই এই তথ্য উঠে এসেছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা পিটিআই।
সফরের আর্থিক চিত্র (এসআইটি সূত্রে)
| খাত | অর্থের পরিমাণ (কোটি রুপি) |
| লিওনেল মেসির পারিশ্রমিক | ৮৯ |
| ভারত সরকারকে প্রদত্ত কর | ১১ |
| মোট ব্যয় | ১০০ |
| স্পনসর থেকে আসা অর্থ (দাবি) | ~৩০% |
| টিকিট বিক্রি থেকে আয় (দাবি) | ~৩০% |
| আয়োজকের অ্যাকাউন্টে পাওয়া অর্থ | ২০+ |
জিজ্ঞাসাবাদে শতদ্রু দত্ত জানিয়েছেন, মেসিকে পারিশ্রমিক দেওয়ার পাশাপাশি ১১ কোটি রুপি কর হিসেবে সরকারকে দেওয়া হয়েছে। এই বিপুল অর্থের জোগান নিয়ে তাঁর দাবি, প্রায় ৩০ শতাংশ এসেছে কর্পোরেট স্পনসরদের কাছ থেকে এবং সমপরিমাণ অর্থ এসেছে টিকিট বিক্রি থেকে। তবে এসআইটি কর্মকর্তারা শতদ্রুর একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে সেখানে ২০ কোটির বেশি রুপি পাওয়ায় বিষয়টি আরও জটিল আকার নিয়েছে। শতদ্রুর বক্তব্য, এই টাকা কলকাতা ও হায়দরাবাদের অনুষ্ঠানের টিকিট ও স্পনসরশিপ বাবদ পাওয়া। যদিও তদন্তকারীরা প্রতিটি লেনদেন খুঁটিয়ে দেখছেন। গত শুক্রবার তাঁর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথিও উদ্ধার করা হয়েছে।
১৩ ডিসেম্বর সল্টলেক স্টেডিয়ামে মেসিকে এক নজর দেখার আশায় চড়া দামে টিকিট কিনেছিলেন হাজার হাজার দর্শক। কিন্তু মেসি মাঠে নামতেই পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায়। প্রায় ৭০ থেকে ৮০ জন ব্যক্তি তাঁকে ঘিরে ধরায় গ্যালারি থেকে দর্শকদের পক্ষে প্রিয় তারকাকে দেখাই অসম্ভব হয়ে পড়ে। ক্ষুব্ধ দর্শকদের একাংশ তখন ভাঙচুর ও লুটপাটে জড়িয়ে পড়ে। স্টেডিয়ামের ভেতরে ও বাইরে পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়ে ওঠে যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্টেডিয়ামের পথে রওনা দিলেও মাঝপথ থেকে ফিরে যেতে বাধ্য হন।
এই ঘটনার পর শতদ্রু দত্তকে হায়দরাবাদ যাওয়ার পথে বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ১৪ ডিসেম্বর তাঁকে ১৪ দিনের পুলিশ হেফাজতে পাঠানো হয়। পুরো ঘটনা তদন্তে রাজ্য সরকার সিনিয়র আইপিএস কর্মকর্তা পীযূষ পান্ডে, জাভেদ শামিম, সুপ্রতিম সরকার ও মুরলীধরের নেতৃত্বে একটি স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম গঠন করে।
জিজ্ঞাসাবাদে শতদ্রু আরও জানান, মাঠে নামার পর মেসিকে বারবার ছোঁয়া ও জড়িয়ে ধরায় তিনি বিরক্ত হন এবং নির্ধারিত সময়ের আগেই মাঠ ছাড়েন। বিদেশি নিরাপত্তা কর্মকর্তারা আগেই সতর্ক করেছিলেন—মেসি পিঠে হাত দেওয়া বা আলিঙ্গন একেবারেই পছন্দ করেন না। অথচ অনুষ্ঠানের সময় পশ্চিমবঙ্গের ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসকে মেসির একেবারে কাছাকাছি অবস্থানে দেখা যায়। ছবি তোলার সময় আর্জেন্টাইন তারকার কোমরে হাত রাখার দৃশ্য নিয়েও বিতর্ক দানা বাঁধে। অভিযোগ ওঠে, তিনি নিজের প্রভাব খাটিয়ে আত্মীয়স্বজন ও ঘনিষ্ঠদের মাঠের ভেতরের এলাকায় ঢোকার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তীব্র সমালোচনার মুখে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ক্রীড়ামন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন অরূপ বিশ্বাস।
পিটিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কীভাবে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ মাঠের ভেতরের সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশাধিকার পেলেন, সেটিই এখন তদন্তের মূল প্রশ্ন। শতদ্রুর দাবি, শুরুতে মাত্র ১৫০টি গ্রাউন্ড পাস ইস্যু করা হয়েছিল। কিন্তু একজন ‘অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি’ স্টেডিয়ামে আসার পর সেই সংখ্যা তিন গুণ করা হয় এবং পুরো পরিস্থিতি তাঁর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই সফরের প্রকৃত আর্থিক ও প্রশাসনিক চিত্র আরও বিস্তারে সামনে আসবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
