বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে উৎসাহ বোনাস প্রদানের নিয়ম আরও কঠোর করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন প্রজ্ঞাপনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে— যে ব্যাংক প্রকৃত নিট মুনাফা অর্জন করতে পারবে না, তারা কোনো অবস্থাতেই কর্মীদের উৎসাহ বোনাস দিতে পারবে না। শুধু তাই নয়, মূলধন ঘাটতি, সঞ্চিতি ঘাটতি বা নিরাপত্তা সঞ্চিতির বিলম্ব সুবিধা নেওয়া ব্যাংকগুলোও বোনাস প্রদান থেকে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ থাকবে।
মঙ্গলবার জারি করা প্রজ্ঞাপনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ব্যাংক কৃত্রিম বা ‘কাগুজে মুনাফা’ দেখিয়ে বোনাস বিতরণ করছে, যা আর্থিক শৃঙ্খলার পরিপন্থী। ভবিষ্যতে বোনাস প্রদানের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে শুধু প্রকৃত আয়–ব্যয়ের ভিত্তিতে অর্জিত নিট মুনাফাকেই বিবেচনায় নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পুঞ্জীভূত মুনাফা (Retained Earnings) থেকে কোনো ধরনের বোনাস দেওয়া যাবে না—এটি এবার প্রথমবারের মতো স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হলো।
Table of Contents
নতুন নীতির বাধ্যতামূলক শর্তাবলি
নতুন নির্দেশনায় বোনাস প্রদানের ক্ষেত্রে যেসব শর্ত পূরণ করা আবশ্যক, তা নিচের টেবিলে দেওয়া হলো—
| শর্ত | ব্যাখ্যা |
|---|---|
| নিট মুনাফা না হলে বোনাস নয় | প্রকৃত আয়–ব্যয় বিবেচনা করে নির্ধারিত নিট মুনাফা থাকলেই কেবল বোনাস দেওয়া যাবে। |
| মূলধন ঘাটতি থাকলে বোনাস নয় | রেগুলেটরি ক্যাপিটাল ঘাটতি থাকা ব্যাংক কোনোভাবেই বোনাস দিতে পারবে না। |
| নিরাপত্তা সঞ্চিতিতে ঘাটতি থাকলে বোনাস নিষিদ্ধ | সঞ্চিতি ঘাটতি থাকলে বোনাস বিতরণ সম্পূর্ণ বন্ধ। |
| বিলম্বিত ছাড় সুবিধা নিলে বোনাস নয় | নিরাপত্তা সঞ্চিতির বিলম্ব সুবিধা নেওয়া বছরের জন্য বোনাস অনুমোদিত নয়। |
| কৃত্রিম মুনাফা দেখানো যাবে না | বাস্তব আয়ের ভিত্তিতেই বোনাস; হিসাব-চালাচালি করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। |
| খারাপ ঋণ আদায়ে অগ্রগতি জরুরি | শ্রেণিকৃত ও অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি থাকতে হবে। |
ব্যাংকিং সূচকে উন্নতির ওপর জোর
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, বোনাস বিবেচনার ক্ষেত্রে শুধু মুনাফার হিসাবই নয়, ব্যাংকের সামগ্রিক কার্যক্রমের স্বাস্থ্যও গুরুত্ব পাবে। এর মধ্যে রয়েছে—
ঋণ পুনরুদ্ধার ও খেলাপি ঋণ কমানো
মূলধন-পর্যাপ্ততা বজায় রাখা
সম্পদের গুণগত মান উন্নয়ন
ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় উন্নতি
করপোরেট গভর্ন্যান্স শক্তিশালী করা
অর্থাৎ, শুধুমাত্র কাগজে-কলমে লাভ দেখিয়ে বোনাস অর্জন আর সম্ভব নয়।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের জন্য অতিরিক্ত বিধান
সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে ‘২০২৫ সালের রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের ইনসেনটিভ বোনাস নির্দেশিকা’ অনুসরণ করতে হবে। এই নির্দেশিকায় তাদের জন্য আলাদা কিছু মানদণ্ড কার্যকর থাকবে, যা বেসরকারি ব্যাংকের তুলনায় আরও কাঠামোবদ্ধ ও কঠোর।
নতুন নিয়মের খাতে সম্ভাব্য প্রভাব
বিশ্লেষকদের মতে, নতুন নির্দেশনা কার্যকর হলে চলতি বছর অনেক ব্যাংকই উৎসাহ বোনাস দিতে পারবে না। কারণ—
উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি রয়েছে
অনেক ব্যাংকের নিরাপত্তা সঞ্চিতি অসম্পূর্ণ
কিছু ব্যাংক বছর শেষে ছাড় সুবিধা নিয়ে কৃত্রিম মুনাফা দেখায়
এখন এসব কৌশল প্রয়োগের সুযোগ আর থাকবে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যে ব্যাংক সত্যিকারের লাভবান, স্বচ্ছ এবং আর্থিকভাবে স্থিতিশীল—শুধুমাত্র সেই ব্যাংকই বোনাস দিতে পারবে। এতে খাতে সুশাসন আরও জোরদার হবে, আর দুর্বল ব্যাংকগুলোও আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী করতে বাধ্য হবে।
সার্বিক বার্তা
এই নতুন প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক স্পষ্ট করেছে—
“বোনাস চাইলে বাস্তব উন্নতি দেখাতে হবে।”
অর্থাৎ, কর্মীদের উৎসাহ বোনাস কেবল সেই ব্যাংকগুলোই পাবে, যারা সত্যিকার অর্থে মুনাফাবান, সুশাসিত ও স্থিতিশীল।