মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় সেনা কর্মকর্তাদের ভার্চুয়াল হাজিরা বাতিল—ট্রাইব্যুনালের কঠোর বার্তা: ‘আইনের বাইরে বিশেষ সুবিধা নয়’

র‌্যাবের টিএফআই সেলে গুম ও নির্যাতনের অভিযোগে দায়ের হওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় গ্রেফতার ১০ সেনা কর্মকর্তার ভার্চুয়াল হাজিরার আবেদন নাকচ করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বুধবার (৩ ডিসেম্বর) ট্রাইব্যুনাল-১–এর চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ এই আদেশ দেন, যা আইনজীবীদের ব্যতিক্রমী বিশেষ সুবিধার দাবিকে কার্যত প্রত্যাখ্যান করল।

আদালতের অবস্থান: ‘ভার্চুয়াল হাজিরার বিধান নেই’

সকালেই গ্রেফতার ১০ সেনা কর্মকর্তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। এরপর অভিযোগ গঠনের শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম অভিযোগপত্র উপস্থাপন করেন। পরে আসামিপক্ষে অ্যাডভোকেট ড. তাবারক হোসেন ভার্চুয়াল হাজিরার আবেদন তোলেন।

আদালত সরাসরি জানতে চান—কোন যুক্তিতে ভার্চুয়াল হাজিরা প্রয়োজন? জবাবে আইনজীবী বলেন, “আসামিরা সেনা কর্মকর্তা। গণমাধ্যমে যে ধরনের প্রচার চলছে, তা তাদের পেশাগত ভবিষ্যৎকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। যদি তারা খালাস পায়, সেনাবাহিনীতে ফিরেও স্থায়ী হননি।”

কিন্তু ট্রাইব্যুনাল যুক্তিটি গুরুত্ব দেয়নি। চেয়ারম্যান জানান—“ট্রাইব্যুনাল আইনে এ ধরনের সুবিধা নেই। রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, মন্ত্রী এমনকি প্রধান বিচারপতি পর্যন্ত আদালতে আসেন। আসামি সেনা কর্মকর্তা হলেই আলাদা সুবিধা দেওয়া যায় না।”

প্রসিকিউটরও জানান—আইন এটি অনুমোদন করে না।

মামলার প্রেক্ষাপট

এটি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত মামলা। অভিযোগ অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে র‌্যাবের টিএফআই সেলে ‘গুম, নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের একাধিক ঘটনা’ ঘটেছে। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়।

বর্তমানে গ্রেফতার ১০ সেনা কর্মকর্তা র‌্যাবে দায়িত্ব পালনকালে অভিযুক্ত হয়েছেন। তারা ২০২৪ সালের শেষ দিকে গ্রেফতার হন।

আদালত–আইনজীবীর যুক্তি–প্রতি-যুক্তি

ট্রাইব্যুনাল আইনজীবী তাবারককে প্রশ্ন করেন—ভার্চুয়াল হাজিরার শুনানি নাকি অব্যাহতির শুনানি? তিনি জানান, অব্যাহতির আবেদন পরে দেবেন, আপাতত ভার্চুয়াল হাজিরার বিষয়েই উপস্থিত হয়েছেন।

ট্রাইব্যুনাল পাল্টা প্রশ্ন তোলে—“আইনের কোন ধারায় আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য?”
তাবারক বলেন—“এটি সম্পূর্ণ আদালতের এখতিয়ার।”

কিন্তু আদালত স্পষ্ট জানায়—গুরুতর অভিযোগের মামলায় আসামির শারীরিক উপস্থিতি অপরিহার্য।

কারা আসামি?

গ্রেফতার ১০ সেনা কর্মকর্তা ছাড়াও মামলার পলাতকদের তালিকায় রয়েছেন—

  • সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

  • সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল

  • সাবেক প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিক

  • সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ

  • আরও তিন প্রভাবশালী কর্মকর্তা

এত উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠায় মামলাটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নজর কাড়ছে।

বিচারের পরবর্তী ধাপ

আদালত ভার্চুয়াল হাজিরার আবেদন খারিজ করে ১৪ ডিসেম্বর আসামিদের অব্যাহতির আবেদনের শুনানি নির্ধারণ করেন। ফলে আগামী শুনানিতে মামলার ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা স্পষ্ট হতে পারে।

বিশ্লেষণ

এই মামলা শুধু আইনি বা প্রশাসনিক বিষয় নয়—রাজনৈতিক, সামরিক এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রেক্ষাপটের সমন্বিত একটি জটিল কাঠামো। ট্রাইব্যুনালের এই সিদ্ধান্ত ইঙ্গিত করে—কোনো আসামি তাদের পদ, পেশা বা প্রভাবের কারণে বিশেষ সুবিধা পাবে না। সেনা কর্মকর্তাদের ‘মিডিয়া ট্রায়ালের’ যুক্তিকে আদালত আমলে না নেওয়ায় স্পষ্ট হলো—ট্রাইব্যুনাল আইনের বাইরে কোনো ব্যতিক্রমিক ব্যবস্থা গ্রহণে প্রস্তুত নয়।