মতিহারের মাটিতে শাহজাহান সিরাজের চিরস্মরণ

আজ মহাপ্রাণ শহীদ শাহজাহান সিরাজের ৪০তম শাহাদাতবার্ষিকী।
১৯৮৪ সালের ২২ ও ২৩ ডিসেম্বর—স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক–কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ) দেশব্যাপী ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল। সেই আহ্বানকে সমর্থন জানিয়ে একাত্ম হয় তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, ১৫টি দল, ৭টি দল, ১৭টি কৃষক ও ক্ষেতমজুর সংগঠন এবং সম্মিলিত আইনজীবী পরিষদ। আন্দোলনের সেই জোর ধর্মঘটকে রূপ দেয় একটি দুর্বার গণহরতালে।

afasfasfdas 1 মতিহারের মাটিতে শাহজাহান সিরাজের চিরস্মরণ

হরতাল সফল করতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতারা ভোরের আলো ফোটার আগেই বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন ও কাজলা গেট এলাকায় অবস্থান নেন। কুয়াশা ভেজা সকালের নীরবতা ভেঙে শুরু হয় মিছিল—শ্লোগানে শ্লোগানে কেঁপে ওঠে মতিহার।

ঠিক সেই সময় রাজশাহী শহরের দিক থেকে বিডিআর ভর্তি একটি ট্রেন এসে থামে বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশনে। বিডিআর সদস্যরা নেমে আগের রাতে দেওয়া ব্যারিকেড সরানোর নির্দেশ দেন। শান্তিপূর্ণভাবে কথা বলার জন্য এগিয়ে যান শাহজাহান সিরাজ, তখনকার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় জাসদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক।

কিন্তু কথার পরিবর্তে তাদের কণ্ঠে উঠে হিংস্র আদেশ:
“লাল সার্ট আলাকে ফায়ার, ফায়ার।”

এক মুহূর্তের মধ্যে গুলি বর্ষিত হয়। লাল সার্টের মধ্যে ছিলেন শাহজাহান সিরাজ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশনের মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আন্দোলনের মহাপ্রাণ। একই সময়ে সোহরাওয়ার্দী হলের তিনতলার বারান্দায় গুলি লাগে পত্রিকার হকার আব্দুল আজিজের মাথায়—সেখানেই তিনি শহীদ হন।

437579ca c91d 4283 bce9 974a8bbd44e1 2 মতিহারের মাটিতে শাহজাহান সিরাজের চিরস্মরণ

সেই দিন ছাত্রদের রক্ত আর শ্রমিকদের রক্ত এক স্রোতে মিশে যায়। তাই ২২ ডিসেম্বর পরিণত হয় “ছাত্র–শ্রমিক সংহতি দিবস”-এ।

সেই একই দিনে, স্টেশন ও হলের মাঝামাঝি স্থানে কোমরে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন সাবেক ছাত্রদল নেতা ও বর্তমান বিএনপি কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ। আমরা হারাই আমাদের প্রিয় নেতা শাহজাহান সিরাজকে, আর রিজভী ভাই বরণ করেন আজীবনের পঙ্গুত্ব।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার প্রথম দিন থেকেই আমি শাহজাহান ভাইয়ের ছায়াসঙ্গী ছিলাম।। প্রায় প্রতিদিনই তিনি বলতেন—“এই ভাঙা ছাত্রলীগকে চাঙ্গা করতে হবে। বগুড়ার সবাইকে দলে আনবে।” বিশ্ববিদ্যালয় সম্মেলনকে সামনে রেখে মৃত্যুর আগের দিনগুলোতে সারাক্ষণই আমি তাঁর সঙ্গে ছিলাম। তিনি ছিলেন সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক, আর আমি ছিলাম প্রচার ও প্রকাশনা উপ-পরিষদের আহ্বায়ক। শাহজাহান ভাই চাইতেন সম্মেলনটা যেন এক বিশাল উৎসবে রূপ নিক। শহীদ হওয়ার পর আমরা তাঁর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পেরেছিলাম—কিন্তু দুর্ভাগ্য, তিনি তা দেখতে পারেননি।

4dff607d c964 41f1 b476 09641b808fcd 1 মতিহারের মাটিতে শাহজাহান সিরাজের চিরস্মরণ

ক্যাম্পাস খোলার পর আমরা আবেগে ভেসে যাই এই মহান শহীদকে নিয়ে। সে সময় আমি ক্যাম্পাসে পরিচিত ছিলাম ‘শ্লোগান মাস্টার’ হিসেবে। শাহজাহান ভাইকে মনে পড়লেই মুখে মুখে জন্ম নিত শ্লোগান—

  • “মতিহারের মহাপ্রাণ, শাহজাহান—শাহজাহান।”

  • “আন্দোলনের মহাপ্রাণ, শাহজাহান—শাহজাহান।”

  • “তোমার আমার প্রাণের প্রাণ, শাহজাহান—শাহজাহান।”

  • “মরেও তুমি অমর আজ, বিপ্লবী শাহজাহান সিরাজ।”

৩৯ বছরে অনেক কিছু হয়তো ভুলে গেছি, কিন্তু শাহজাহান ভাইকে ভুলতে পারিনি। প্রতি বছর ২২শে ডিসেম্বর মনে হয়—যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য শত শহীদ বুকের তাজা রক্ত ঢেলেছিল, সেই গণতন্ত্র কি আজও সত্যিকার অর্থে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে?

শেষে কবি মোহন রায়হানের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে হয়:
“শোক নয়, প্রতিশোধ নেব আজ—ঘুমাও শান্তিতে, শাহজাহান সিরাজ।”

শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও অগ্নিশপথে—মহাপ্রাণ শহীদের প্রতি অবনত শির।

লেখকঃ সম্পাদক ও প্রকাশক, খবরওয়ালা।