বিপর্যয়, দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড বা ব্যবসায়িক ক্ষতির মুহূর্তে আর্থিক সুরক্ষা দেওয়ার কথা বিমা খাতের। কিন্তু বাস্তবে চিত্রটি সম্পূর্ণ বিপরীত। নানা ধরনের সাধারণ বিমা পলিসির গ্রাহকরা মাসের পর মাস, কখনও বছরের পর বছর ধরে যথাযথ ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না। এতে বহু মানুষ আর্থিক সংকট, ব্যবসায়িক অনিশ্চয়তা ও মানসিক চাপের মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন।
২০২৫ সালের জুলাই–সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের পরিসংখ্যান বলছে, সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলো এ সময়ে মোট দাবির মাত্র ৭.৫৫% নিষ্পত্তি করতে পেরেছে। তার আগের এপ্রিল–জুন প্রান্তিকে নিষ্পত্তির হার ছিল ৮.৩২%—অর্থাৎ মাত্র তিন মাসে প্রায় ৯.২৫% কমে গেছে। এটি স্পষ্টভাবে দেখায় যে খাতটির আর্থিক সক্ষমতা, তারল্য ব্যবস্থাপনা এবং কার্যক্রমে দুর্বলতা ক্রমেই বাড়ছে।
বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) অনিরীক্ষিত তথ্য অনুযায়ী, জুলাই–সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলোর মোট দাবি ছিল প্রায় ৩,৬৩৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ২৭৫ কোটি, ফলে প্রান্তিক শেষে ৩,৩৬৩ কোটি টাকা দাবি এখনো ঝুলে রয়েছে।
দাবি নিষ্পত্তির বর্তমান অবস্থা (জুলাই–সেপ্টেম্বর ২০২৫)
| প্রতিষ্ঠান | মোট দাবি (কোটি টাকা) | নিষ্পত্তি (%) | অবশিষ্ট দাবি (কোটি টাকা) |
|---|---|---|---|
| জেনারেল ইনস্যুরেন্স করপোরেশন | — | ৩.৩৭% | ২,১৪২.৩৭ |
| গ্রিন ডেলটা ইনস্যুরেন্স | — | ৮.২৬% | ২৬৬.৫৪ |
| প্রগতি ইনস্যুরেন্স | — | — | ১৫৭.৯১ |
| রিলায়েন্স ইনস্যুরেন্স | — | — | ৯৮.৯১ |
| পিপলস ইনস্যুরেন্স | — | — | ৮০.৮০ |
দাবি নিষ্পত্তিতে এই দীর্ঘসূত্রতা সাধারণ গ্রাহকদের চরম দুর্ভোগে ফেলছে। অনেক ক্ষেত্রেই পলিসির মেয়াদ শেষ হওয়ার কয়েক বছর পরও ক্ষতিপূরণ মেলেনি। এতে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে হতাশা ও অবিশ্বাস বাড়ছে, যা বিমা খাতের প্রতি জনগণের আস্থাকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করছে।
জেনারেল ইনস্যুরেন্স করপোরেশনের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, প্রায় ৮০% দাবিই বিলম্বিত হচ্ছে জরিপ প্রতিবেদনের দেরির কারণে। দুর্ঘটনা বা ক্ষতির পর ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে জরিপ রিপোর্ট ছাড়া কোম্পানি এগোতে পারে না। অনেক রি-ইনস্যুরেন্স (পুনর্বিমা)–সম্পর্কিত দাবির ক্ষেত্রে এই জরিপ পেতে ৫–৭ বছর পর্যন্ত লেগে যায়। ফলে বিদেশি রি-ইনস্যুরারদের সঙ্গেও নিষ্পত্তি আটকে যায়, যা গ্রাহকদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সময় আরও পিছিয়ে দেয়।
গ্রিন ডেলটা ইনস্যুরেন্স জানায়, দেরির অন্যতম কারণ হলো গ্রাহকদের অসম্পূর্ণ ও আইনগতভাবে দুর্বল নথি জমা দেওয়া। প্রমাণপত্র, পুলিশ বা ফায়ার সার্ভিস রিপোর্ট, জরিপ প্রতিবেদন, মালিকানার কাগজ বা বিল-ভাউচার অসম্পূর্ণ হলে যাচাই প্রক্রিয়া দীর্ঘ হয়। অনেকে প্রকৃত ক্ষতির চেয়ে বেশি ক্ষতিপূরণ দাবি করেন, যা নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হলে মামলা বা সালিশে সময় চলে যায়।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো পলিসিতে অন্তর্ভুক্ত নয় এমন ঝুঁকি নিয়ে দাবি দাখিল করা। রাজনৈতিক সহিংসতা, নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা ধীরে হওয়া ক্ষতি—এসব অনেক সময় পলিসির আওতায় না থাকায় যাচাই, ব্যাখ্যা ও আইনি জটিলতা তৈরি হয়।
স্টেট–ওনড সাদারণ বীমা করপোরেশন (এসবিসি)–এর বিলম্বও প্রক্রিয়াকে আরও ধীর করে। আইনে আছে, সাধারণ বিমার ৫০% পুনর্বিমা এসবিসির মাধ্যমে করতে হবে। কিন্তু এসবিসি সময়মতো তার অংশ নিষ্পত্তি না করায় বীমা কোম্পানিগুলো প্রাথমিক দাবি নিষ্পত্তি করতেও দেরি করছে।
একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, “অনেক সময় সম্পূর্ণ অনুমোদিত দাবি কয়েক মাস ধরে ঝুলে থাকে। পুনর্বিমার বিলম্ব, অতিরিক্ত নথিপত্রের প্রয়োজনীয়তা এবং আদালতের মামলা পুরো প্রক্রিয়াকে ধীর করে দেয়।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমস্যা শুধু অর্থনৈতিক মন্দা নয়, বরং দুর্বল নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা। আইডিআরএ দীর্ঘদিন ধরেই নিয়ম ভঙ্গকারী কোম্পানিগুলোকে কঠোরভাবে জবাবদিহির আওতায় আনতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে দাবি নিষ্পত্তিতে গাফিলতি ও দায়িত্বহীনতা বাড়ছে।
সারসংক্ষেপ
দাবি নিষ্পত্তির হার কমছে দ্রুত
পলিসি–ধারীরা বছরের পর বছর অপেক্ষায়
জরিপ রিপোর্টের বিলম্ব সবচেয়ে বড় বাধা
অসম্পূর্ণ নথি ও মামলা দাবিকে আরও জটিল করছে
পুনর্বিমায় এসবিসির বিলম্ব পুরো খাতকে ধীর করে দিচ্ছে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন—সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া আস্থা ফিরবে না
