বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, সংখ্যালঘু পরিস্থিতি এবং ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ নিয়ে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কে যে টানাপোড়েন চলছে, তাতে ভারতের পূর্বের অবস্থানে কোনো গুণগত পরিবর্তন আসেনি। গত শুক্রবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে স্পষ্ট করেছেন যে, বাংলাদেশ বিষয়ে ভারত তার আগের অবস্থানেই অনড় রয়েছে। প্রায় ৩৫ মিনিট স্থায়ী এই সংবাদ সম্মেলনে সংখ্যালঘু সুরক্ষা, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, শেখ হাসিনার হস্তান্তরের আইনি জটিলতা এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তার মতো সংবেদনশীল ইস্যুগুলো প্রাধান্য পেয়েছে। ভারতের এই অনড় অবস্থান ইঙ্গিত দেয় যে, বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক এখনও একটি অস্বস্তিকর ও পর্যবেক্ষণমূলক পর্যায়ে রয়েছে।
সংখ্যালঘু পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের উদ্বেগের বিষয়টি ব্রিফিংয়ের মূল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। মুখপাত্র জয়সোয়াল ময়মনসিংহে একজন হিন্দু যুবককে হত্যার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। তিনি দাবি করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ২ হাজার ৯০০টিরও বেশি সহিংসতার ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে, যেগুলোকে কেবল ‘মিডিয়া অতিরঞ্জন’ বলে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। যদিও বাংলাদেশ সরকার বারবার এই অভিযোগগুলো নাকচ করে বলছে যে, অধিকাংশ ঘটনা রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত বিরোধের জের এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রশাসন জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে বড় করে না দেখার জন্য ঢাকাকে বারবার দিল্লির প্রতি আহ্বান জানাতে দেখা গেলেও ভারতের পক্ষ থেকে উদ্বেগের সুর এখনও উচ্চকিত।
বাংলাদেশে আগামী সংসদ নির্বাচন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ নিয়ে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি পুনরায় ব্যাখ্যা করেন রণধীর জয়সোয়াল। তিনি বলেন, ভারত বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে, যেখানে প্রতিটি দলের সমান সুযোগ থাকবে। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সম্ভাব্য নির্বাচন নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি সরাসরি কোনো দলের নাম না নিলেও সবার অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনামলে ভারত তাঁর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মিত্র হিসেবে পাশে থাকলেও, বর্তমান পরিস্থিতিতে দিল্লি ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচনের কথা বলে কার্যত সব রাজনৈতিক শক্তির অন্তর্ভুক্তির প্রতি ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে কূটনীতিবিদরা মনে করছেন।
নিচে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে আলোচিত মূল বিষয়সমূহ একটি ছকের মাধ্যমে তুলে ধরা হলো:
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে আলোচিত মূল বিষয়সমূহ
| আলোচনার বিষয় | ভারতের আনুষ্ঠানিক অবস্থান ও বক্তব্য |
| সংখ্যালঘু সুরক্ষা | উগ্রবাদীদের সহিংসতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ; ২,৯০০+ ঘটনার দাবি। |
| সংসদ নির্বাচন | অবাধ, সুষ্ঠু এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের পক্ষে জোরালো সমর্থন। |
| হাসিনা প্রত্যর্পণ | আইনি প্রক্রিয়া ও জটিলতার উল্লেখ; বিষয়টি বর্তমানে ‘যথা-পূর্ব’ অবস্থায়। |
| ভারতবিরোধী প্রচারণা | বিষয়টিকে ‘মিথ্যা আখ্যান’ হিসেবে প্রত্যাখ্যান; আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব ঢাকার। |
| আঞ্চলিক নিরাপত্তা | বাংলাদেশের বন্দরে পাকিস্তানি জাহাজের উপস্থিতি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা। |
| দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ | উন্নয়ন সহযোগিতা ও আর্থিক সম্পর্কের বিষয়ে ভারত ইতিবাচক থাকতে চায়। |
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা এবং বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাঁকে হস্তান্তরের অনুরোধ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে জয়সোয়াল আইনি মারপ্যাঁচের ইঙ্গিত দেন। তিনি জানান, আইনের দৃষ্টিতে পলাতক ব্যক্তিদের বিচার নিশ্চিত করতে ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকলেও এ ধরনের প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়ায় অনেক আইনি ধাপ এবং জটিলতা জড়িয়ে থাকে। বাংলাদেশের বর্তমান অনুরোধের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর মন্তব্য ছিল, “বিষয়টি যে পর্যায়ে ছিল, সেখানেই আছে।” অর্থাৎ প্রত্যর্পণ ইস্যুতে ভারতের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো পদক্ষেপের সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না।
আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রশ্নে বাংলাদেশের বন্দরে পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজের উপস্থিতি এবং পাকিস্তানি নৌবাহিনী প্রধানের সফর নিয়ে ভারত তাঁর সতর্ক অবস্থানের কথা জানিয়েছে। জয়সোয়াল জানান, ভারত এ ধরনের সব ঘটনা অত্যন্ত নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। অন্যদিকে, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতির গুঞ্জনের মাঝেও বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো খাতে ভারতের বিনিয়োগ এবং ‘লাইন অব ক্রেডিট’ (এলওসি) সংক্রান্ত কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে দিল্লি। জয়সোয়াল উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা এই সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর এবং ভারত বাংলাদেশের স্থিতিশীলতাকে সর্বদা অগ্রাধিকার দেয়।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের ক্ষমতার যে বিশাল পটপরিবর্তন হয়েছে, তা দিল্লি এখনও মানসিকভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। তবে দীর্ঘমেয়াদী আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে এই পরিবর্তনকে বাস্তবসম্মতভাবে মেনে নিয়ে নতুন পথে হাঁটা জরুরি। গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইপিএসএস-এর প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামানের মতে, দুই দেশের সম্পর্কের বর্তমান সংকটের মূল কারণ বিপ্লবোত্তর পরিবর্তনকে ভারতের মেনে নিতে না পারা। ভবিষ্যতের স্বার্থে একে অন্যের ভালো প্রতিবেশী হিসেবে থাকা এবং জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে বিদ্যমান সংকটগুলো দ্রুত নিরসন করা প্রয়োজন।
