দেশের ব্যাংকিং খাতের সংস্কার প্রক্রিয়ায় এক ঐতিহাসিক ও নজিরবিহীন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি একীভূত হওয়া পাঁচটি শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ারের মূল্য ‘শূন্য’ ঘোষণার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলো হলো—ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল্যায়ন অনুযায়ী, এই ব্যাংকগুলোর নিট সম্পদের মূল্য (NAV) নেতিবাচক হয়ে পড়ায় এমন কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান জানান, ‘ব্যাংক রেজোলিউশন অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর আওতায় এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পুনর্গঠিত এই ব্যাংকগুলোর শেয়ারের মূল্য এখন ঋণাত্মক, যার ফলে বিদ্যমান শেয়ারহোল্ডারদের মালিকানা বাতিল করে তা শূন্যে নামিয়ে আনা হয়েছে। এর আগে গত নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন যে, শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদের মূল্য ৩৫০ থেকে ৪২০ টাকা পর্যন্ত ঋণাত্মক হয়ে পড়ায় এই ব্যাংকগুলোর পুরনো শেয়ারহোল্ডাররা নতুন একীভূত ব্যাংক ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক পিএলসি’-তে কোনো অংশীদারিত্ব পাবেন না।
ব্যাংকগুলোর এই আর্থিক বিপর্যয়ের ফলে শেয়ারহোল্ডাররা বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। ফেস ভ্যালু বা অভিহিত মূল্য অনুযায়ী এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪,৫০০ কোটি টাকা। তবে বাজারমূল্য বিবেচনায় এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১,০২২ কোটি টাকা, কারণ শেয়ারবাজারে এই ব্যাংকগুলোর শেয়ারের দাম দীর্ঘ সময় ধরেই অভিহিত মূল্যের নিচে অবস্থান করছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই মার্জার আদেশের পরপরই ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ এই ব্যাংকগুলোর শেয়ার লেনদেন স্থগিত করে দেয়।
একীভূত ব্যাংকগুলোর শেয়ার ও পুঁজির তুলনামূলক চিত্র:
| বিবরণ | তথ্যাদি ও পরিমাণ |
| অন্তর্ভুক্ত ব্যাংকসমূহ | ফার্স্ট সিকিউরিটি, সোশ্যাল ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী, ইউনিয়ন ও এক্সিম ব্যাংক |
| নতুন ব্যাংকের নাম | সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক পিএলসি |
| অনুমোদিত মূলধন | ৪০,০০০ কোটি টাকা (প্রতিটি ১০ টাকা মূল্যের ৪,০০০ কোটি শেয়ার) |
| পরিশোধিত মূলধন | ৩৫,০০০ কোটি টাকা |
| সরকারি বিনিয়োগ (শ্রেণি-এ) | ২০,০০০ কোটি টাকা |
| প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারী (শ্রেণি-বি) | ৭,৫০০ কোটি টাকা (স্থায়ী আমানত থেকে রূপান্তরিত) |
| অন্যান্য প্রতিষ্ঠান (শ্রেণি-সি) | ৭,৫০০ কোটি টাকা (আমানত থেকে রূপান্তরিত) |
নতুন গঠিত ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক পিএলসি’ এখন দেশের বৃহত্তম রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক এই ব্যাংকটিকে চূড়ান্ত লাইসেন্স প্রদান করে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের খসড়া প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ব্যাংকটির মূলধনের কাঠামো তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া ২০,০০০ কোটি টাকার বিপরীতে তারা ‘এ’ শ্রেণির শেয়ারহোল্ডার হিসেবে গণ্য হবে। এছাড়া অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী আমানত থেকে ৭,৫০০ কোটি টাকা এবং বিভিন্ন অ-আর্থিক প্রাতিষ্ঠানিক আমানত থেকে আরও ৭,৫০০ কোটি টাকা শেয়ার মূলধনে রূপান্তর করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া ব্যাংকিং খাতের বৃহত্তর সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মূল লক্ষ্য হলো ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং বিশৃঙ্খল আর্থিক ব্যবস্থাকে একটি সুশৃঙ্খল কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা। আমানতকারীদের সুরক্ষা এবং দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখতেই এই কঠোর কিন্তু প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন।
