ধর্মীয় বিশ্বাস, কুসংস্কার আর অলৌকিক শক্তির ভরসায় মানুষের দুর্বলতাকে কেন্দ্র করে প্রতারণা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে নতুন নয়। তবে প্রযুক্তি ও শিক্ষার প্রসার সত্ত্বেও এ ধরনের প্রতারণা বন্ধ না হয়ে বরং নতুন কৌশলে বাড়ছেই। এরই একটি উদাহরণ বগুড়ার সোনাতলায়। ঝাড়ফুঁকের মাধ্যমে ‘জিনের বাদশা’ সেজে সাধারণ মানুষকে ধোকা দিয়ে লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে মহিদুল ইসলাম (৩৫) নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
বগুড়া জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) মো. আতোয়ার রহমান শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) বিকেলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানান, দীর্ঘদিন ধরে মহিদুল নিজেকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে পরিচয় দিতেন। তিনি দাবি করতেন, তার নির্দেশে ‘জিন’ মানুষের সমস্যা সমাধান করে, অশুভ আত্মা তাড়ায়, এমনকি ভাগ্যও পরিবর্তন করে দিতে পারে। এই আড়ালে তিনি মানুষকে ঝাড়ফুঁক করে সুস্থ করার নাম করে বিভিন্ন ফাঁদ পেতে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিতেন।
Table of Contents
পরিচয় থেকে প্রতারণা—ঘটনার শুরু মহাস্থানগড়ে
মামলার বিবরণ অনুযায়ী, সেনাবাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার (অব.) মোমিনুর রহমানের সঙ্গে মহিদুলের পরিচয় হয় বগুড়ার মহাস্থানগড় এলাকায় একটি ইসলামী জলসায়। সেখানে মহিদুল নিজেকে ‘জিনের বাদশা’ পরিচয়ে পরিচিত করান এবং দাবি করেন তিনি বিশেষ ঝাড়ফুঁকে নানা জটিল সমস্যা সমাধান করতে পারেন। ধীরে ধীরে সম্পর্ক তৈরি করে তিনি ভুক্তভোগীর বিশ্বাস অর্জন করেন।
পরবর্তীতে গত ৭ সেপ্টেম্বর তিনি মোমিনুর রহমানকে সমস্যার বিশেষ সমাধান করার কথা বলে বাড়িতে ডেকে নেন। সেখানে খাবারের সঙ্গে অজ্ঞান করার ওষুধ মিশিয়ে তাকে অস্বাভাবিক অবস্থায় ফেলে রাখেন। সুযোগ বুঝে নগদ অর্থ ও বিকাশের মাধ্যমে মোট প্রায় ১২ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন।
গ্রেপ্তার অভিযান ও উদ্ধারকৃত প্রতারণার সরঞ্জাম
অভিযোগ পাওয়ার পর পুলিশ তদন্তে নেমে ঘটনাটির সত্যতা নিশ্চিত হয়। এরপর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) বৃহস্পতিবার রাতে সোনাতলার রানিরপাড়া গ্রামে অভিযান চালিয়ে মহিদুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে।
তার বাড়িতে তল্লাশি চালানো হলে উদ্ধার করা হয় প্রতারণায় ব্যবহৃত নানা সামগ্রী—
দুটি কথিত হাড়
তাবিজ ও সুরমাদানি
লাল ও সাদা কাপড়
তছবি
আতর ও আগরবাতি
কালো সুতা
পুলিশের ধারণা, এ সবই ‘ঝাড়ফুঁক’ ও ‘জিনের ডাক’ দেখানোর উপকরণ হিসেবে ব্যবহার হতো।
প্রতারণার স্বীকারোক্তি
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মহিদুল টাকা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ‘জিনের বাদশা’ নামে এলাকায় পরিচিত ছিলেন এবং সুযোগ পেলেই অসুস্থ ব্যক্তি বা সমস্যাগ্রস্ত মানুষদের সাজানো গল্প শুনিয়ে টাকা নিতেন। পুলিশের মতে, গ্রামে শিক্ষাগত সীমাবদ্ধতা, কুসংস্কারে বিশ্বাস এবং মানসিক দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে এমন প্রতারকের সংখ্যা বাড়ছে।
সামাজিক প্রেক্ষাপট ও বিশ্লেষণ
বাংলাদেশে দরিদ্র ও মাঝারি আয়ের মানুষদের মধ্যে অলৌকিক চিকিৎসা ও ভাগ্য বদলের আকাঙ্ক্ষা অনেক। একদিকে বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসার খরচ বৃদ্ধি, অন্যদিকে ধর্মীয় আবেগ—এই দুইয়ের মিশেলে গ্রামে-গঞ্জে ‘জিনের বাদশা’, ‘পীর’, ‘ফকির’ নামে অসংখ্য প্রতারক সক্রিয় রয়েছে। তারা সাধারণত মানুষের দুর্বল মুহূর্তকে কাজে লাগায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের প্রতারণা বন্ধ করতে প্রয়োজন—
ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক সচেতনতা বৃদ্ধি
গ্রামে চিকিৎসা ব্যবস্থা আরও সহজলভ্য করা
প্রতারণার ঘটনায় দ্রুত মামলা তদন্ত ও কঠোর শাস্তি
গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারণা
বর্তমানে মামলাটি তদন্তাধীন এবং পুলিশ বলছে, প্রয়োজন হলে আরও ধারায় মামলা রূপান্তর করা হবে।
