শীতের শুরুতেই দেশের সংগীতপ্রেমীদের জন্য ছিল দারুণ খবর। বিভিন্ন আয়োজক প্রতিষ্ঠান ঘোষণা করেছিল দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান শিল্পীদের নিয়ে প্রায় ছয়টি (৬টি) বড় কনসার্টের। এই তালিকায় বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড ও শিল্পীদের পাশাপাশি ভারতের এবং পাকিস্তানের জনপ্রিয় তারকারাও ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বর্তমানে নিরাপত্তা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে প্রশাসনের কাছ থেকে অনুমতি না পাওয়ায় একের পর এক কনসার্ট বাতিল বা স্থগিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে স্থগিতের ঘোষণা এসেছে তিনটি (৩টি) বহুল প্রতীক্ষিত কনসার্টের। বাকি তিনটি (৩টি) কনসার্ট আদৌ নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠিত হবে কি না, তা নিয়ে দর্শক-শ্রোতাদের মনে গভীর শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এই অপ্রত্যাশিত ধারাবাহিক বাতিল প্রক্রিয়া শীতকালীন কনসার্ট সিজনের আনন্দকে ম্লান করে দিয়েছে।
এই বাতিল হওয়া কনসার্টগুলোর মধ্যে প্রথম ছিল পাকিস্তানি সংগীতশিল্পী আলী আজমতের একক পরিবেশনা। ১৪ নভেম্বর ঢাকায় গান শোনানোর কথা ছিল এই কিংবদন্তি শিল্পীর। ‘লেজেন্ডস লাইভ ইন ঢাকা’ শীর্ষক এই মেগা কনসার্টে বাংলাদেশের রক আইকন নগর বাউল জেমসেরও গাওয়ার কথা ছিল। কনসার্টে অংশ নিতে আলী আজমত নির্ধারিত সময়ের তিন দিন আগেই ঢাকায় পৌঁছান, যা তাঁর অনুরাগীদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু কনসার্টের দিন সকালেই আয়োজক প্রতিষ্ঠান অপ্রত্যাশিতভাবে জানায় যে নিরাপত্তার কারণে এই আয়োজনটি স্থগিত করা হয়েছে। এই ঘোষণায় হতাশ হন হাজার হাজার টিকিট কেটে রাখা দর্শক।
এরপর স্থগিত করা হয় পাকিস্তানের আরেক জনপ্রিয় ব্যান্ড জালের কনসার্ট। আয়োজক প্রতিষ্ঠান স্টেইজ কো-এর উদ্যোগে জাল ব্যান্ডের কনসার্ট হওয়ার কথা ছিল ২৮ নভেম্বর রাজধানীর ৩০০ ফুটের সন্নিকটে অবস্থিত স্বদেশ অ্যারেনায়। ‘সাউন্ড অব সোল’ শিরোনামের এই কনসার্টে দেশের অন্যতম সেরা দুটি ব্যান্ড ওয়ারফেজ ও লেভেল ফাইভেরও পারফর্ম করার কথা ছিল। ব্যান্ড জালের বাংলাদেশে পারফর্ম করার খবরটি তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। কিন্তু সেই উত্তেজনাও প্রশমিত হয় নিরাপত্তা ইস্যুতে কনসার্ট স্থগিতের ঘোষণার মাধ্যমে।
সর্বশেষ বাতিল করা হয়েছে ভারতের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী অনুভব জৈনের কনসার্ট। এই কনসার্টটি ১২ ডিসেম্বর ঢাকার ১০০ ফুটের কোর্টসাইড মাদানি অ্যাভিনিউতে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। তবে ২৫ নভেম্বর আয়োজক প্রতিষ্ঠান হাইপনেশন আনুষ্ঠানিকভাবে এটি স্থগিতের ঘোষণা দেয়। এতে ভারতীয় বাংলাভাষী ও হিন্দি গানপ্রেমী দর্শকদের মধ্যে হতাশা নেমে আসে। এই তিনটি কনসার্ট বাতিল হওয়ার পেছনে প্রশাসনের অনুমতি না পাওয়াকেই মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, দেশের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ বিদেশি শিল্পীদের উপস্থিতিতে বড় ধরনের জনসমাগমের ঝুঁকি নিতে চাইছে না।
এদিকে, আগামী কয়েক সপ্তাহের জন্য আরও দুটি (২টি) বড় কনসার্ট নির্ধারিত আছে, যেখানে পারফর্ম করার কথা রয়েছে পাকিস্তানি ব্যান্ড কাভিশ ও খ্যাতিমান সংগীতশিল্পী আতিফ আসলামের। আগামী ৫ ডিসেম্বর ঢাকার মাদানি অ্যাভিনিউয়ের কোর্টসাইডে ‘ওয়েভ ফেস্ট: ফিল দ্য উইন্টার’ শিরোনামের কনসার্টে কাভিশ ব্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড শিরোনামহীন ও মেঘদল-এর গান শোনানোর কথা আছে। কনসার্টটি আয়োজন করছে প্রাইম ওয়েভ কমিউনিকেশন।
অন্যদিকে, ১৩ ডিসেম্বর মেইন স্টেজ আয়োজিত এক কনসার্টে ঢাকায় গান শোনানোর কথা আতিফ আসলামের। এ ছাড়া ‘ইকোস অব রেভল্যুশন ২.০’ শিরোনামের একটি চ্যারিটি কনসার্টেও আতিফের পারফর্ম করার কথা আছে। সম্প্রতি আতিফের কনসার্টটিও বাতিলের গুঞ্জন উঠে আসে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খবর ছড়ায় যে আয়োজকেরা এখনো ভেন্যু কর্তৃপক্ষের চূড়ান্ত অনুমতি পাননি। তবে আয়োজক প্রতিষ্ঠান মেইন স্টেজ কয়েক দিন আগে নিশ্চিত করেছে, সমস্ত আইনি ও নিরাপত্তা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে নির্ধারিত সময়েই আতিফ আসলামের কনসার্ট অনুষ্ঠিত হবে।
এই অনিশ্চয়তার মধ্যেও কিছু আয়োজক প্রতিষ্ঠান অনলাইনে টিকিট বিক্রির কার্যক্রম পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছে। এতে দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেকে মনে করছেন, চূড়ান্ত অনুমোদন না পাওয়া সত্ত্বেও টিকিট বিক্রি করাটা এক ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে। যদিও আয়োজকেরা আশ্বস্ত করছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিদেশি শিল্পীদের এই কনসার্টগুলো নির্ধারিত সময়ে মঞ্চস্থ হবে কি না, তা নিয়ে একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন থেকেই যাচ্ছে। এই ধারাবাহিক বাতিল প্রক্রিয়ার ফলে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক ধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছে এবং আন্তর্জাতিক কনসার্ট আয়োজনের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে, এই সময়ে ঢাকার বাইরে মফস্বল শহরগুলোতে এবং ঢাকার ভেতরেও বিভিন্ন করপোরেট শো ও পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে দেশীয় ব্যান্ড ও শিল্পীরা নিয়মিত পারফর্ম করছেন, যা কিছুটা হলেও সাংস্কৃতিক শূন্যতা পূরণ করছে। এই পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক না হলে আন্তর্জাতিক সংগীতপ্রেমীরা হতাশ হতে পারেন। কনসার্ট বাতিলের এই ধারা দেশের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট শিল্পকেও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
